বর্ষণহীন বর্ষার বিদায়!

44

তুষার দেব

বাংলা বর্ষপঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ সোমবার শ্রাবণের শেষদিন। ঋতু পরিক্রমায় আগামীকাল মঙ্গলবার পয়লা ভাদ্রে শরতের যাত্রা শুরু। কাগজে-কলমে বর্ষার বিদায় হতে চললেও প্রকৃতিতে বিরাজমান আবহাওয়ার অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এখনও দেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। তবে তাপপ্রবাহে সওয়ার হওয়া এবারের বর্ষা শেষপর্যন্ত বর্ষণহীনতায় বিদায় নিতে চলেছে বলেই ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক শেষে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল সেখানে বর্ষার বিদায়বেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর শ্রাবণের একেবারে শেষে এসে প্রকৃতিতে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতেও বর্ষার বর্ষণহীন বিদায়ের আলামতই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আগস্টের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, জুলাইয়ের মতো চলতি আগস্টেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হতে পারে। তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে দিন ও রাতের তাপমাত্রা।মাসের দ্বিতীয়ার্ধে ভারী বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিতে পারে বন্যা। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি বর্ষাকালীন লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। পাশাপাশি এ মাসে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলেও পূর্বভাসে উল্লেখ করা হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জুলাই মাসের পর্যবেক্ষণ তুলে প্রতিবেদনে জানায়, জুলাইয়ে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃষ্টি কম হয়েছে। ওই মাসে শুধুমাত্র সিলেট বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। মৌসুমি বায়ু দুর্বল থাকার কারণে ওই মাসের শুরু এবং শেষের দিকে বেশ কয়েকদিন রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, সিলেট বিভাগ এবং কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তাপপ্রবাহ চলাকালে রাজশাহী ও সৈয়দপুরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এছাড়া জুলাই মাসে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল।
আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা বর্ষপঞ্জির শ্রাবণ মাস বৃষ্টির ভরা মৌসুম হলেও এবার কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা মিলেনি। উল্টো বৃষ্টিহীনতার মধ্যেই ভরা বর্ষায় মানুষকে সইতে হয়েছে তাপপ্রবাহের দাপট। বর্ষা মৌসুমের বেশিরভাগ সময়জুড়ে অস্বস্তিকর উষ্ণতা অনুভ‚ত হয়েছে সর্বত্র। বর্ষণহীনতার কারণে এবারের বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি থাকছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড বলছে, শুধুমাত্র দেশের উত্তরাঞ্চলেই গত বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একশ’ ৩৭ মিলিমিটার, দ্বিতীয় সপ্তাহে একশ’ ৩৫ এবং তৃতীয় সপ্তাহে একশ’ ৩১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। এবার জুলাই মাসে এত কম পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে যে, তা রেকর্ডই করা যায়নি। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বর্ষা মৌসুমের এই সময়ে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তার থেকে ৬০ শতাংশ কম। ফলে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলায় খরা পরিস্থিতির কারণে চাষাবাদ দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। আবার দেশের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু স্থলভাগে বিস্তার লাভ করার শুরুতে টানা কয়েকদিন যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর আর ভারি বৃষ্টির দেখাই মিলেনি।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক পূর্বদেশকে বলেন, ঋতু পরিক্রমার হিসাবে বর্ষাকালের বিদায়ের সময় হলেও প্রকৃতিতে বিরাজমান আবহাওয়ার অবস্থায় এখনই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বিদায় ঘটছে না। সেদিক থেকে বর্ষার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা একেবারেই ফুরিয়ে গেছে বলা যাবে না। তবে এবারের বর্ষা মৌসুমে সারাদেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। অনেকের কাছে বর্ষা এবার ঠিক চেনারূপে ধরা দেয়নি। সাগরে মৌসুমি বায়ুর অবস্থান বেশিরভাগ সময়ই মাঝারি থেকে দুর্বল অবস্থায় পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই স্থলভাগে সক্রিয় থাকলেও প্রত্যাশিত বৃষ্টির দেখা মিলেনি। এই মুহূর্তে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি নি¤œচাপ অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর পারে। এ কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। মৌসুমি বায়ু উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অত্যন্ত সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। নি¤œচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং দেশের সমুদ্রবন্দরসমূহ ও উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। তাই চট্টগ্রাম মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপক‚লকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
অধিদপ্তর থেকে আজ সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল রোববার বরিশাল ও পটুয়াখালীতে দেশের সর্বোচ্চ ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকায় রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।
উল্লেখ্য, বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাব ধরে আষাঢ়-শ্রাবণকেই বর্ষাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষার রেশ থেকে যায়। অর্থাৎ জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তই বর্ষা মৌসুম গণনা করা হয়ে থাকে।