বর্ষণমুক্ত দিন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

30

শেষ সপ্তাহজুড়ে একটানা অব্যাহত থাকার পর আষাঢ়ের বিদায়ের দিনে বিরতি নিয়েছিল চলতি বর্ষা মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণ। পরদিন মানে গতকাল মঙ্গলবার শ্রাবণের যাত্রা শুরুর দিনে প্রকৃতি পুরো চট্টগ্রাম বিভাগেই বর্ষণমুক্ত দিনই উপহার দিল। তাতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদে দেখা দেয়া স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতিরও আরও খানিকটা উন্নতি হয়েছে। দু’দিন ধরে বানের পানি নেমে যাওয়া অব্যাহত থাকায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জনজীবন। আপাতত ভারী বর্ষণের আর কোনও সতর্কবার্তাও দেয়নি আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যানে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায়নি। সারাদেশেও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে। মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের কুমারখালী এলাকায়। একই বিভাগের উপর দিয়ে আবার মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তা অব্যাহত থাকার খবরও দিয়েছে অধিদপ্তর। দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও তাই রেকর্ড করা হয়েছে বিভাগের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরে। সারাদেশের মধ্যে খুলনার কুমারখালী ছাড়া একই বিভাগের যশোর, পার্শ্ববর্তী বরিশাল বিভাগের ভোলা, রাজশাহী বিভাগের তাড়াশ আর ময়মনসিংহে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দুই অংকের কোটা পূরণ করতে পেরেছে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগও ছিল অনেকটাই বৃষ্টিশূন্য। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বৃষ্টি না হওয়ায় বাড়ি-ঘর ও সড়ক-মহাসড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গিয়ে বিপর্যস্ত চেহারা ভেসে উঠেছে। তবে, ক্ষেত-খামারের ফসলাদি এখনও পানির নিচেই তলিয়ে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকেও নদ-নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ নিচের দিকে নেমে বিপদসীমার কিছুটা ওপর দিয়েই প্রবাহিত হওয়ার খবর জানানো হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, মৌসুমী অক্ষের বর্ধিতাংশ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল অতিল্ডম করে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সল্ডিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা দূর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। আর পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরণের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। পরবর্তী দু’দিনে আবহাওয়ার অবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের আলামত দেখা না গেলেও বর্ধিত পাঁচদিনে বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর আগে গত ৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগে টানা ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল বিস্তীর্ণ জনপদে বান ডেকে আনে। আষাঢ়ের বিদায়ের দিনে গত সোমবার চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে বিরতি নিয়েছিল মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণধারা। তাতেই আকাশে মেঘের আড়াল সরিয়ে দেখা মিলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের। সূর্যের দিনমান এই হাসি পরম আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয় বানভাসী মানুষের জীবনে। বর্ষণ-বিরতিতে বানের পানি ধীরে ধীরে নামতে থাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতিও উন্নতির দিকে পথচলা শুরু করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ভারী বর্ষণকবলিত বিগত দশদিনে শুধু চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টিপাতের সাথে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নগরীতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কমবেশি ১৪ উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। একইভাবে কক্সবাজারের চকরিয়াসহ তিন পার্বত্য জেলায়ও লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বানের পানির নিচে ডুবে যায় সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। নদীর ভাঙনকবলিত এলাকার শতাধিক বাড়িঘর স্রোতে ভেসে গেছে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, ইছামতি, ডাবুয়া, সর্তা, ও শঙ্খ নদীর পানি এখনও প্রবাহিত হচ্ছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে। ভূমিধসে হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
এদিকে, রেকর্ড ছাড়ানো ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হলেও দেশে ‘ভয়াবহ বন্যা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বিগত ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ এর মতো বড় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সাধারণত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার পানি একযোগে বাড়লেই দেশে বড় বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আপাতত তিন অববাহিকায় একইসঙ্গে পানি বাড়ার কোনও আলামত দেখছেন না সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে আর দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ যাত্রায় বন্যার ব্যাপ্তিকাল এক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। আর জুলাই মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অধিদপ্তর জানিয়েছিল, জুলাইয়ের মধ্য ও শেষভাগে মৌসুমী বায়ু দেশের ওপর প্রবলভাবে সক্রিয় হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে। একই কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম এবং মেঘালয়েও যদি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ে, তাতে পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হতে পারে। এজন্য মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।