বর্ণিল উৎসবে উদ্বোধন

10

ঢাকা প্রতিনিধি

প্রমত্তা পদ্মার তীরে উন্মোচিত হল ফলক, বাতাসে উড়ল রঙিন আবির, দিকে দিকে উঠল জয়বাংলা স্লোগান; গতকাল শনিবার বর্ণিল উৎসবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে দেশের দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের বহুকাল থেকে দেখে আসা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলো ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে পদ্মার দুই তীরের তিন জেলার পাশাপাশি সারা দেশেই ছিল উৎসবের রঙ। বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশ সাজানো হয় অসংখ্য ব্যানার-ফেস্টুনে।
পদ্মাপাড়ের আনুষ্ঠানিকতা সাজানো হয়েছিল মূলত দুই ভাগে। মাওয়ায় রাষ্ট্রীয় আয়োজনে হয় সুধী সমাবেশ, যেখানে সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, কূটনীতিকসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
মঞ্চের দুই পাশে দুটো ডায়াস আর তার দুটো জায়ান্ট স্ক্রিন। এক পাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, অন্য পাশে তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি।
স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন অতিথিদের আসনে।
আরও ছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন, ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী।
পদ্মাসেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাক টিকিট, স্মারক নোট, স্যুভেনির শিট, সিলমোহর ও উদ্বোধন খাম উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সেতুর দুই তীরে ফলক উন্মোচন করে সারেন উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা।
এখন সেতুর ওপর দিয়ে কয়েক মিনিটেই দেওয়া যাবে প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি। তাই উচ্ছ¡াসে ভাসলো পদ্মাপাড়ের মানুষ থেকে শুরু করে দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষ। পথে-ঘাটে, চায়ের কাপে, আড্ডায়-আলোচনায় সেই আনন্দেরই অনুরণন। তাদের চোখেমুখে ছিলো স্বপ্নপূরণের আলোকছটা।
প্রাণের সে উৎসবের ছটা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। সড়ক-মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও অলিগলি ছেয়ে গেছে পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড আর তোরণে। যতদূর চোখ যায় যেন রঙের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন স্থানে করা হয়েছে আলোকসজ্জা। মরিচবাতিতে উজ্জ্বল সেতু, নৌকা আর জাতীয় পতাকার প্রতিকৃতি।
মাওয়া প্রান্তে সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে গড়ে তোলা হয় পদ্মা সেতুর আদলে বিশাল নান্দনিক মঞ্চ। নিরাপত্তাজনিত কারণে জনসভা মঞ্চ, পদ্মা সেতু ও এর ভায়াডাক্ট এবং আশপাশের এলাকায় বৃহস্পতিবার থেকে সাধারণ মানুষকে ভিড়তে দেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সেতু উদ্বোধনের পর অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশাল সমাবেশ। সারা দেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাগম ঘটে সমাবেশস্থলে। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চের সামনে বিশাল আকৃতির এক নৌকা রাখা হয়েছে। সেখানে নৌকা এমনভাবে রাখা হয়েছে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন পানির ওপর ভাসছে।
সভাকে ঘিরে দৃষ্টিনন্দন এক্সপ্রেসওয়ে সাজানো হয়েছে অসংখ্য ফেস্টুন দিয়ে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে বর্ণিল উৎসব বয়ে যায় শিবচরে। বিভিন্ন সড়কের ডিভাইডার, জনসভাস্থলসহ দু’পাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় করা হয়েছে আলোকসজ্জা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো মানুষের ভোগান্তির ইতি ঘটলো কাল থেকে। পদ্মা পার হওয়ার ঝক্কিঝামেলার অবর্ণনীয় কষ্ট, কখনো কখনো এক পাড়েই বিনিদ্র রজনী যাপন, স্বজন হারানোর ঘটনা বা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, এসব কষ্টের গল্প আর কখনো এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ফিরে আসবে না।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘিরে ঢাকা-মাওয়া এবং জাজিরার টোল প্লাজা থেকে শরীয়তপুর ও ভাঙ্গা মহাসড়কের দুই পাশে নানা ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। অনেক স্থানে আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে পদ্মা সেতুতে অসংখ্য ট্রলার, নৌযান ঘুরতে দেখা গেছে, যেগুলো রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘পদ্মা সেতু দেয়ালে, খেয়ালে’ স্লোগানে শরীয়তপুর সদর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার সকালে তুলাসার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের দেয়ালে উদ্বোধন করা হয়েছে দেয়ালিকা। শিমুলিয়া ঘাটে শোভাযাত্রা করেছে টুরিস্ট পুলিশ।
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সড়ক-মহাসড়ক, রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও অলিগলি পোস্টার, ব্যানার আর বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ও সংসদ-সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের প্রতিকৃতি।
বিভিন্ন পয়েন্টে আলোকসজ্জায় সৃষ্টি হয়েছে উৎসবের আমেজ। ৩ হাজার বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার লাগানো হয়েছে। ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিমউদ্দিন জানান, সেতু উদ্বোধন ঘিরে এ অঞ্চলে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
বর্ণিল রূপে সেজেছে শরীয়তপুর শহরসহ ৬ উপজেলা। রঙ-বেরঙের ব্যানার, ফেস্টুন, নিশান, তোরণের পাশাপাশি চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. সেলিম জানান, এক্সপ্রেসওয়েকে সাজানো হয়েছে দলীয় নেত্রীর ব্যানার পোস্টার দিয়ে। মোড়ে মোড়ে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং-এ ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে ছোট বড় বিলবোর্ডগুলো এখন সুসজ্জিত দলীয় নেতাকর্মীদের পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানারে। কেউ কেউ জায়গা খালি না পেয়ে বাঁশের সাহায্যে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল আকৃতির প্রতিকৃতি শোভা পেয়েছে উদ্বোধন স্থলে। কেরানীগঞ্জ আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে ধলেশ্বরী টোল প্লাজায়, কুচিমোড়া, নিমতলা স্ট্যান্ডগুলো আশপাশে এবং হাইওয়ের কিনারে শোভা পায় অন্যান্য জেলার নেতাকর্মীদের ব্যানারও।
শরীয়তপুরের পদ্মা তীরবর্তী ঘাটগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ বাহারি রংয়ে সাজানো হচ্ছে নৌকা, লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান।
সাগর পারের জেলা পটুয়াখালী ও বরগুনায়ও উৎসবের আমেজ বইছে। শুধু আ.লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যেই না, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকার জুরাইন থেকে পদ্মা সেতুর দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। এ পথে নির্মাণ করা হয়েছে এশিয়ার অন্যতম সুন্দর মহাসড়ক ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। মহাসড়কটি সেজেছে বর্ণিল সাজে। সড়কের দুই পাশে ঝুলছে অসংখ্য রঙিন ব্যানার, ফেস্টুন। এতে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
যাত্রী ছাউনিগুলো লাইটিং করা হয়েছে। লাল-সবুজ রঙের টিস্যু ব্যবহার করে এতে জাতীয় পতাকাকে তুলে ধরা হয়েছে। মহাসড়কটির কিছু দূর পরপর রঙ-বেরঙের ফ্ল্যাগ বসানো হয়েছে।