বন্ধ সময়েও ১৭৩১ পাসপোর্ট আবেদন, তিন হাজার টাকায় দ্রুত মিলে পাসপোর্ট

125

মুক্তিযোদ্ধা জয়হরি সিকদার। স্বামী-স্ত্রী দুজনই পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এরমধ্যে আবেদনের ৬ মাস পর স্ত্রীর পাসপোর্ট হাতে পেলেও এখনো নিজের পাসপোর্টটি অধরা। আবেদনের দীর্ঘ ৭ মাসেও পাসপোর্ট না পেয়ে শেষ জীবনেও বিদেশ ভ্রমণ অপূর্ণ থাকার শঙ্কা সত্তরোর্ধ এই মুক্তিযোদ্ধার। একইভাবে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মা-মেয়ে মিলে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন জয়নাব বেগম। আবেদনের সাত মাসেও হাতে পাননি কাক্সিক্ষত পাসপোর্ট বই। বারেবারে ধর্না দিলেও দুইজনের বইগুলো প্রিন্ট হয়নি বলে জানানো হয়। ভিন্ন উপায়ে জানতে পারেন, তিন হাজার টাকা বিকাশ পেমেন্ট করলেই দ্রুত মিলবে পাসপোর্ট বই।
আবেদনকারী জয়নাব বেগমের মেয়ে জামাই ফারুক আল আজাদ পূর্বদেশকে বলেন, শাশুড়ি ও স্ত্রীর পাসপোর্ট পেতে বারবার ধর্না দিয়েছি এখনো নাগাল পাইনি। তবে একজন দালাল একটি মোবাইল নম্বর ধরিয়ে দিয়ে জানালো সেই নম্বরে তিন হাজার টাকা বিকাশ পেমেন্ট করলেই পাসপোর্ট মিলবে। খোঁজ নিয়ে জানলাম নম্বরটি পাঁচলাইশ অফিসে চাকরি করে বর্তমানে ঢাকায় বদলি হওয়া এক কর্মচারীর। যে কারনে ক্ষোভে টাকাও দিইনি, পাসপোর্টও পাইনি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভিসা ও পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘করোনার কারনে রি-ইস্যু ও জরুরী কিছু পাসপোর্ট ছাড়া বাকি আবেদন বন্ধ। আবেদন বন্ধ থাকলেও পাঁচলাইশে এত আবেদন জমা হওয়ার বিষয়টি আমি অবগত নই। দালালের উপদ্রব বাড়ার বিষয়ে আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদনের পরেও দীর্ঘদিন পাসপোর্ট না পাওয়ার কেন্দ্রীয়ভাবে সৃষ্ট সমস্যাটি টাকা দিলেই নিমিষেই দূর হয় পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে দালাল ধরলেই যেন সব হালাল হয়ে যায়। আবেদিত ফি-র বাড়তি তিন হাজার টাকা দিলেই দ্রুত পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেন পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, করোনাকালীন সময়ে নতুন আবেদন বন্ধ থাকলেও গত সাড়ে তিন মাসে প্রচুর পাসপোর্ট আবেদন গৃহীত হয়েছে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে। যার বেশিরভাগই জরুরী (এক্সপ্রেস) আবেদিত। করোনাকালীন সময়ে বিদেশ যাওয়া বন্ধ ও পাসপোর্ট পেতে দীর্ঘসূত্রিতার পরেও এত বেশি জরুরী আবেদনে দুর্নীতির আভাস মিলছে। মূলত আবেদিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে দুই থেকে তিনগুণ বাড়তি টাকা নিয়েই এসব আবেদন জমা দিতে উৎসাহিত করেছেন দালালচক্র। আবেদিত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা তদন্ত করলেই বের হবে কারা পাসপোর্ট রি-ইস্যু ও অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে আবেদন করেছেন।
পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, করোনাকালীন সময়েও ১ হাজার ৭৩১টি পাসপোর্ট আবেদন গৃহীত হয়েছে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে। এরমধ্যে মে ও এপ্রিল মাসে একটিও পাসপোর্ট আবেদন জমা হয়নি। কিন্তু জুন থেকে রি-ইস্যু এবং বিশেষ শ্রেণির আবেদন নেওয়া শুরু হয়। এরমধ্যে জুন মাসে জমা পড়েছে ৯৩৮টি ও ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১৯৩টি পাসপোর্ট আবেদন জমা পড়েছে। জমা পড়া এসব পাসপোর্টের এক হাজার ১৪১টিই জরুরী (এক্সপ্রেস) আবেদন।
করোনার প্রভাব, পাসপোর্ট পেতে দীর্ঘসূত্রিতা ও বিদেশে যাতায়াত বন্ধের পরেও এত পাসপোর্ট আবেদন কেন তার উত্তরে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মাসুম হাসান পূর্বদেশকে বলেন, ‘করোনার এই সময়ে কোন পাসপোর্ট আবেদন জমা নেয়া হয় না। শুধুমাত্র রি-ইস্যু পাসপোর্ট জমা নেয়া হয়। তবে বিশেষ কারণে অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে কিছু পাসপোর্ট আবেদন নিতে হয়। যার বেশিরভাগই সরকারি কর্মকর্তা ও অফিসিয়াল রিকুয়েস্টে জমা নিতে হয়। কাউন্টার সবসময় ফাঁকা থাকে। ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় আবেদন নেওয়া বন্ধ রয়েছে। এই অফিসে কোন দালাল নেই। বাইরে দালাল থাকলে আপনারা ধরিয়ে দিন। টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে দ্রুত পাসপোর্ট কিভাবে তারা আনে আমরা জানি না। এখনো প্রায় ১৫ হাজারের উপরে পাসপোর্ট ঢাকায় আটকা আছে।’
পাঁচলাইশ অফিসে পাসপোর্ট রি-ইস্যুকারী দুবাই প্রবাসী মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন জানান, ‘গতবছর ১ অক্টোবর আমি নিজে আমার মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট রি-ইস্যুর জন্য আবেদন করি। ডেলিভারীর নির্ধারিত সময় ২২ অক্টোবরের পরেও পাসপোর্ট না পেয়ে পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে খবর নেই। তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে জানতে পারি আমার পাসপোর্টের জন্য পাঁচলাইশ অফিসের ফরোয়ার্ডিং লাগবে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ খোঁজাখুজির পরও পাসপোর্ট অফিসের কোথাও আমার আবেদন ফরমটি পাওয়া যায়নি। পাসপোর্ট অফিসের লোকজন আমাকে একবার দ্বিতীয় তলায় আরেকবার নিচতলায় একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর রুমে গিয়ে খুঁজতে বলেন। উপায় না পেয়ে আমিও তাই করি। কিন্তু পায়নি। একপর্যায়ে আমার সংরক্ষণে থাকা আবেদন ফরমের একটি ফটোকপি পাসপোর্ট অফিসে দ্বিতীয়বার জমা দেই। কিন্তু পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে ঢাকা থেকে কোন চিঠি আসেনি বলে জানানো হয়। চিঠি আসলে আবেদন ফরমটি যাচাই করে এপ্রæভাল দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন জানায় এরকম শতশত আবেদন জমা পড়ে আছে যাদের চিঠি কখনোই আসেনা। এপ্রূভাল পাঠানো তো দূরের কথা। প্রতিদিন আমার মত অনেকেই পাসপোর্টের জন্য অফিসে এসে ধর্না দেন। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। কিছুদিন পর আবার আসেন। কিন্তু কোন লাভ হয়না।’
পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তির শিকার আরো কয়েকজন জানান, এ পাসপোর্ট অফিস ঘিরে কমপক্ষে ৩০ জনের দালালচক্র সক্রিয় আছে। দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন জমা হচ্ছে প্রতিদিন। যে কারণে করোনায় আবেদন বন্ধ থাকলেও বেশি আবেদন জমা পড়ছে। কাউন্টার ফাঁকা থাকলেও দালালের সহায়তায় এ অফিসের অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত পাসপোর্ট আবেদন জমা নিচ্ছেন। যা রি-ইস্যু ও বিশেষ শ্রেণির (জটিল রোগে আক্রান্ত) আবেদন হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এসব আবেদনে সরকারের নির্ধারিত ফির দুই থেকে তিনগুণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্রটি। পরে আবার দ্রুত প্রিন্ট করাতেও প্রতি পাসপোর্টে দাবি করছে বাড়তি টাকা।
ভোগান্তির শিকার মানুষের এমন অভিযোগের প্রমাণ মিলে গত ১৯ জুলাই দুপুরে। পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের তথ্য ডেস্কের সামনে রাখা বেঞ্চে বসা ছিলো দুই ব্যক্তি। পরিচয় গোপন রেখে সমস্যার কথা বলতেই সহায়তার হাত বাড়ান একজন। ঢাকায় আটকে থাকা পাসপোর্ট দ্রুত আনতে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন তিনি। তথ্য ডেস্কে বসা পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী গাজী ও মসজিদ ইমামের সামনেই মিজান নামের পঞ্চাশোর্ধ ওই দালাল পাসপোর্ট জমার কপির সাথে দাবি করেন তিন হাজার টাকা। এসময় নিজের পকেটে থাকা দশটির মতো আবেদনের কপি বের করে পাসপোর্ট আনার অভিজ্ঞতাও বিশ্লেষণ করেন তিনি। আলাপচারিতার একপর্যায়ে জানালেন, তিনি পাসপোর্ট অফিসে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন। সেখানে সবাই তাকে ‘মিজান মামা’ নামেই চিনেন। পরে মোবাইল নাম্বার দিয়ে যে কোন পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
গতকাল সোমবার সকালে দালাল মিজানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তিন হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন বৃহস্পতিবারে পাসপোর্ট পাবেন। আমি ঢাকায় কথা বলেছি। তারা দ্রুত জমা স্লিপ পাঠাতে বললো। আপনি যখন যোগাযোগ করেছেন দ্রুত জমা স্লিপ ও টাকা পাঠিয়ে দিন।’