বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ

69

আরিফুল হাসান

লেখতে বসলেই সেই ঘ্রাণটি পায় জামিল। জামিল আবেদীন একজন কবি। প্রচলিত কথাশিল্পের বাজারে তার কবিতাও মোটামুটি ভালোই চলছে। কিন্তু ইদানিং কী যেনো হয়েছে! যখনই লেখতে বসে তখনই একটি সুগন্ধ এসে তার সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। একেবারে বেপরোয়া ভাবে তার ভাব এবং ভাষাকে কেড়ে নেয়। বিমোহিত হয়ে লেখক কলমে কাগজের উপর ডট এঁকে বসে থাকে। কোনো লেখা এগোয় না। না চিন্তারা এসে ধরা দেয়, না কল্পনারা পাখা মেলে উড়ে। কোথায় যে সব অনুভুতি পালিয়ে যায়, বুঝতে পারে না। হে খোদা, বাঁচাও আমাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে সে। লেখতে না পারলে তার বাঁচন নেই। কবিতাতেই প্রাণপাখি বাঁধা। একটা অস্থিরতা অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে তার ভেতর, মৃত্যুরও অধিক। যেনো দম বন্ধ হয়ে আসে। দমের ঘরের ঘরি টিকটিক করে চলতে চলতে থেমে যায়। এমন যে ঝড়-জলের কবি, এমন যে শীত-রুদ্রতার তীব্র কবিপনা, সবকিছু থেমে যায় সেই মোহিনী-মোহন সুগন্ধ নাকে এলে। কবি তখন ডায়রি উল্টিয়ে সিগারেট জ্বালায়। হাতের ফাঁকেই পুড়তে পুড়তে লম্বা ছাই আপনা থেকে পড়ে বইপত্রের উপর। কবির তখন সেদিকে খেয়াল থাকে না। পুড়তে পুড়তে আঙুলে এসে ছেকা লাগলে সম্বিৎ ফিরে তার। আপন মনে হেসে উঠে। আবার একটি সিগারেট জ্বালায়। কিন্তু না সরে নাকের কাছ থেকে সেই সুঘ্রাণ, না হয় লেখা তার কোনো কবিতা।
এমনটি শুরু হয় বেশ কিছুদিন আগে। সেদিন ফ্রেব্রুয়ারির চৌদ্দ তারিখ। পার্কের মঞ্চে বসন্তদিনের কবিতা পড়ে ফিরছে বাসায়। সেদিনই তার পাশের বাসায় একটি নতুন দম্পতি আসে। পাশের বাসা মানে গলির উল্টো দিকে দেড় তলা বিল্ডিং। তার বিল্ডিংটিও একতলা। খোলা ছাদে বিকেল সন্ধ্যায় বসে থাকার অভ্যেস আছে। গলির শেষ মাথায় দুপাশে দুটি বাসা, একটিতে কবি জামিল আবেদীন আজ মাস ছয়েক হলো ভাড়া থাকে। অপরটি অবশ্য খালিই ছিলো। বাড়িওয়ালা খোদ আমেরিকা নিবাসী। সেখানেই থাকাজোকার সব জোগারজন্তর। তাই দেশের এই উপকণ্ঠী শহরের গিঞ্জিগলির শেষ মাথায় পৈত্রিক দেড় তলা বিল্ডিংটার কোনো খবর রাখে না। আবার বিক্রিও করে না; পৈত্রিক ভিটার টান বলে একটি কথা আছে সে জন্যে। তো, বাসাটি খালিই পড়ে থাকে। জামিল উঠার এই ছ মাসের মধ্যে কখনো এ বাড়িতে কোনো লাইট জ্বলতে দেখেনি। সেদিন সে গলির মুখ থেকেই দেখতে পায় তার বাসার বিপরীত দিকের বাসার ছাদে একটি উচ্চআলোর বাতি জ্বলছে। এবং বাতির আলোয় কয়েকজন মানুষ আগাছা পরিস্কার করছে হয়তো, তা এণ দূর থেকে দেখা যায় না। আরেকটু এগিয়ে গেলে নিশ্চিত হয় যে, প্রায় পরিত্যাক্ত বাড়িটির ছাদে গজিয়ে উঠা অসংখ্য মস, গুল্ম আর ফাঙ্গাসের বুকে ঝনাৎ ঝনাৎ ছুড়ি চালাচ্ছে তিনজন মানুষ। দুটো পুরুষ, একজন রমনী। জামিল একটু থমকে দাঁড়ায়। এণ কি তাড়া ছিলো? আজই তারা উঠেছে। এখন ভেতরঘরের জিনিসপত্তর গোছগাছেই তো নজর দেয়ার কথা বেশি। কিন্তু না, এই সন্ধ্যা মাড়িয়ে রাতের পথে তারা কিনা ছাদ পরিস্কার করতে নেমেছে! তাজ্জব লাগে। জামিল দেখে, পুরুষ দুজন ভাবলেও আসলে একজন কিশোর, কিশোর মানে প্রায় কিশোর। তবে গায়ে বায়ে বেশ বড় হয়ে গেছে। আরেকজন বেটেখাটো ধরণের চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছরের পুরুষ হাতে কাস্তে নিয়ে দায়সারা ভাবে কেটে যাচ্ছে মস, গুল্ম। তবে সবচেয়ে বেশি এক্টিভ দেখা যায় রমনীটিকে। তার বয়স হবে ত্রিশ কি বত্রিশ। চুলখোলা পিঠে ইলেক্ট্রিক উচ্চ আলো ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎ¯œার মহিমা নিয়ে। জামিল যখন বিল্ডিংটির নিকটে আসে তখন সে প্রাণ মাতোয়ালা করা একটি সুঘ্রাণ পায়। সে ভেবে পায় না এটি কোন ফুলের ঘ্রাণ। পরিচিত কোনো ফুলের কথা মনে আসে না। তবে গন্ধটি তাকে আবিষ্ট করে রাখে। সে আরও দু’পলক দাঁড়ায়। ওপাশের বিল্ডিংটির ছাদে এখনও সেই তৎপরতার সাথে দুহাতে কাজ করে যাচ্ছে রমনিটিঅ এবং ফাঁকে ফাঁকে সাথের দুজনকেও তাড়াও দিচ্ছে, কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। পুরুষটি হয়তো ঘেনর ঘেনর করে আপত্তি তুলছে এই রাতের বেলায় কাজ করার ব্যাপারে, কিন্তু নারীকণ্ঠটি উচ্চে বেজে উঠে, রিনিক ঝিনিক ছন্দে জানায়, Ñরাতেই শেষ করতে হবে।
রাতের মধ্যেই শেষ হয়। সকালে উঠে জামিল যখন ছাদে যায় তখন তার চক্ষু চড়ক গাছ। সত্যিই, একরাতের মধ্যেই চেহারাটা পাল্টে গেছে বাড়িটার। অনেগুলো টব নান্দনিক করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে একটি কাঠের বেঞ্চি পাতা হয়েছে, Ñযেখানে দেয়ালঘেসে দাঁড়িয়ে থাকা আমগাছটির ছায়া এসে ছড়িয়ে পড়ে। ভালো লাগে ব্যাপারটা জামিল আবেদিনের কাছে। একটি মৃত বাড়িতে প্রাণ ফোটানোর ঘটনাটি তার কাছে বেশ কাব্যিক মনে হয়। ছাদে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ গলির উল্টোদিকের ছাদবাগানটিকে দেখে। কতো রকম ফুলের গাছ, কতো রকম রং! কতো যে সুভা সে ফুলের, কতো যে সুবাস! কিন্তু গতরাতের সেই মোহিনী গন্ধটা সে পায় না। সে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে, না, এমন কোনো বিশেষ গন্ধের পরিচিত কোনো ফুল নেই সেখানে। কিন্তু সুবাসটি সে পেয়েছিলো, গতকাল বিল্ডিংটির সামনে দিয়ে আসার সময় নাকের অভ্যন্তরে যে মধুময় সুবাস লেগেছিলো তার ঘোর কাটেনি সারা রাতেও। কিন্তু এই সকালবেলা ফুলের রাজ্য চোখের সামনে রেখে সে সেই গন্ধের হদিস পায় না। সে ফিরে আসে। আর লেখার টেবিলে বসলেই সেই প্রাণহরা গন্ধটা সে আবারও পায়। তারপর থেকে যতবারই লেখতে বসেছে, ততবারই সে হৃদয়হরা সুঘ্রাণ তার ধ্যানে দিয়েছে ভগ্নযোগ। সে লেখা ফেলে দৌঁড়ে গিয়েছে ছাদে। দেখেছে, চোলখোলা পিঠে রোদের ঢেউ তুলে, কিংবা জ্যোৎ¯œার মানটিত্র পিঠের পরিধিজুড়ে এঁকে সেই অপরূপ রূপসী রমনীটি বসে আছে কাঠের বেঞ্চে, তার দিকে পিঠ দিয়ে। সে মুখটি দেখে না।
শৈশবে মার্জিয়াদের বাগানে ফুল তুলতে যেতো সে। শহীদ মিনারে ফুল দেবার জন্য রাতের অন্ধকারে যেতো ওরা। কিন্তু মার্জিয়া কিভাবে যে টের পেয়ে যেতো। রাতের বেলাতেই কেঁদে কেটে একসা করে ফেলতো সব। জামিলদের তখন পালানোর জায়গা থাকতো না। কাঁদলে মার্জিয়ার শরীর থেকে এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ বের হতো। জামিলের হঠাৎ মনে হয়, এ গন্ধটি মার্জিয়ার শরীরেরই গন্ধ। হ্যাঁ, তার চেনা আছে। শৈশব-কৈশোরজুড়ে কতোবার যে সে মার্জিয়াকে কাঁদতে দেখেছে, এবং তার শরীর থেকে পেয়েছে এমন তীব্র অথচ সুমিষ্ট সুবাস। সে অবাক হয়। তবে কি ভাগ্যের জোড়ে মার্জিয়াই তার বাসার বিপরীতে বাসা নিয়েছে? ভাবনাজুড়ে তখন মার্জিয়া আর পিঠখোলা নারী, কল্পনাজুড়ে তখন ফেলে আসা শৈশব আর বিপরীত ছাদের রহস্যময় সুগন্ধ। কোনো কিছুর কূল কিনারা পায় না সে। সে কেনো লিখতে বসলেই নারীটি চুলখোলে বাইরে এসে দাঁড়ায়? সে কেনো লেখতে বসলেই এমন সুরভি এসে বিমোহিত করে দেয়? হাতের সিগারেটটি এ্যাসট্রেতে গুঁজে সে ছাদের দরজা খোলে বাইরে যায়। খোলা দুপুরে পিঠখোলা রমনীটি বসে আছে কাঠের বেঞ্চে। তার বড় ইচ্ছে হয় একবার মার্জিয়া বলে ডাক দিতে।