বনাচারী মানুষের মন

47

আরিফুল হাসান

কবিরকে আমরা সবাই ঘৃণা করতাম। কী আছে কবিরের? না ঘর, না পিতৃপরিচয়। পড়ে থাকা মাঠের মতো, মরে যাওয়া মায়ের স্মৃতি ধরে সৎ বাবার সাথে থাকে। সে-কি থাকা? না থাকার মাঝেও নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখা। এই নাম মাত্র থাকাতেও কবিরের আনন্দ। অথবা বেদনার রং তার চোখে মুখে এমনভাবে লেপ্টে গেছে যে আমরা তার ভালো থাকা বা মন্দ থাকাটা আলাদাভাবে ধরতে পারতাম না। তবে এটুকু বুঝতাম-কবির আমাদের মতো নয়। তখন ভয় হতো, আসলেই কিকবিরকে আমরা ঘৃণা করি, নাকি ভয় পাই? তখন মনে হতো ভয়পাই। সত্যিই ভয় পাই কবিরকে। আমাদের কৌতুহল বেড়ে যেতো। সারাদিন বনে বাঁদারে ঘুরে বেড়ানো কবিরের দেহে পিতাভ রং, মুখখানা সব সময়ের জন্য ভাবলেশহীন। আমরা এগিয়ে যেতাম কবিরের সাথে মিশতে। আবার পাশ ফিরে শোবার মতো মুখ ঘুরিয়ে নিতাম কবির থেকে। মনে হত দুঃস্বপ্ন দেখছি কোনো। কবিরের মুখ যখন দেখতাম, তখন নিঃসঙ্গ রাতের মতো একটা হাহাকার আমাদেরকে ছুঁয়ে যেতো। আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতাম। নিতাম অবশ্য কারন আছে। আমাদের গার্জিয়ানরা খুব কড়া করেনা করে দিয়েছিল কবিরের সাথে মিশতে। কোথাকার কোন জন্মপরিচয়হীন সন্তান, মায়ের সাথে জুড়ে এসে বসেছে মকবলের কাঁধে। মা তোতার থাকেনি। দুবছর যেতেনা যেতেইমা-টামরল। কাঁধে চেপে রইলো না বালক কবির। মকবল দরিদ্র সংসার আর একাকীত্বের যাতনা সইতেনা পেরে আবার বিয়ে করলো। সে ঘরেও সন্তানাদি হলো। শুধু সন্তান না হয়েও সে ঘরে বেড়ে উঠতে থাকলো কবির।
কবিরের বয়স বারোকি চৌদ্দ। তার এই সৎমায়ের সংসারে তিনজন ঝি। ছেলে পুলের আশায় কবির আবার রাত্রি হলে উপগত হয়। কিন্তু এবারও সন্তান আসে মেয়ে। মকবুলের মন কালো মেঘের মতো জমাট বাঁধতে থাকে। ক্ষোভ এসে পড়ে কবিরের উপর। কথায় কথায় হালের লাঠি দিয়ে, মাছ ধরা জালের বাঁশ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারে তাকে। কবির কাঁদে না। বিতাড়িত কুকুরের মতো মুখ গুঁজে ঘরের এ কোনা থেকে সে কোনায় যায়। ঘাটায় গিয়ে বসে থাকে। বাড়ির দক্ষিনে বয়ে যাওয়া পৌঢ়া খালটির ঘোলা স্রোতে নিজেকে কল্পনা করে ঝিমোয়। তারপর হয়তো উঠে যায় সুলতানদের তালপুকুর পাড়ে। সেখানে এখন সারি সারি আমের গাছে মনকাড়া আম। পেঁকে আপনা আপনি পড়ছে গাছ থেকে। কিন্তু সুলতানদের বুড়ো খুঁড়িটাও সব ধরতে দেয় না কাউকে। ভুতের মতো ফজরের আগ থেকে রাত জমে যাওয়া পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় আম গাছ থেকে আম গাছ তলায়। তবুবুড়ির চোখ ফাঁকি দিয়ে দুয়েকটা আম পাওয়া যায়। বিশেষ করে উত্তর পাড়ের যে জঙ্গল, বেথুম ঝোপ, গাইট্টারা কাঁটার বিস্তার, বিষাক্ত কালোকচু, ছিপটিন ঝোঁপ, পুমা গাছের অসংখ্য বিস্তার, বন কলমির ঝোঁপ, একান্ত আবশ্যিকভাবে বাঁশ ঝাড়, কাঁটা ঝোঁপ ও মুর্তার বন দিনের বেলাকেও যেখানে অন্ধকার করে রাখে, সেখানে টক-ছোবড়া আম কুড়াতে বুড়ি খুব কমইযায়। গ্রামের দুরন্ত ছেলেরা, অভাবী সংসারের ছেলে মেয়েরা সাঁপজোঁকের ভয়কে অগ্রাহ্য করে সেখানে আম কুড়াতে যায়। কখনো কখনো বিষাক্ত সাঁপের মুখোমুখি হয়। তারা দুরু দুরু বুকে কাঁপতে কাঁপতে রুদ্ধ শ্বাসে দৌঁড়ে তারা দুরু দুরু বুকে কাঁপতে থাকে। কখনো জোঁক আঠার মতো লেগে যায় পায়ে, রক্ত খেয়ে ঢোল হয়। ছেলে মেয়েরা এসব বিপদ অগ্রাহ্য করেই সেখানে যায়। কবির ও যায়। তার যখন মন খারাপ হয়, খুব বেশি কাঁদতে ইচ্ছে করেতখন সে সুলতানের পুকুর পাড়ের এই জঙ্গলটির ভেতর যায়। দুয়েকটা বুনো ফলটল হয়তো কুড়িয়ে পায়। হয়তো তার ইচ্ছে হয় বিষাক্ত সাপেটা পেতাকে কেটে ফেলুক। কিন্তু সে মরেনা। এক দুপুর জঙ্গলে কাটিয়ে আবার সে ফিরে আসে।
বাড়িতে আসলে সৎ মা হয়তো তাকে ভাত দেয় না। বাবাটার হয়তো মায়া লাগে। আপন না হোক, মৃত বিবির গর্ভের ধন তো। তার কাছে তো আমানত। তখন সে হয়তো কবিরকে আড়ালে ডেকে দুটো পয়সা ধরিয়ে দেয়। কবির হবির মার দোকান থেকে একটা পাওন কিনে পেট নিস্তার করে। মুখ মুছে সে দুতিন মগ জল খায়। তারপর আবার কোথাও হারিয়ে যাবার আগে একবার সে খুশি মনে মকবলের সামনে যায়। হাসি হাসি মুখকরে দাঁড়ায়। মকবল তখন হয়তো তার প্রতি আরেকটু মায়া বাড়ায়। হয়তো বলে, -খরোডাতযাইয়াবচ্চা। কয়ডা মাছ পাইলে অদো বিহালে বাজার নেওন যাইবো। কবির তখন পৌঢ়া খালটাকে ঘিরে রাখা খরোজালের উপরে গিয়ে বসে। দূর থেকে দেখে আমাদের কাছে সিংহাসন মনে হয়। কবির পায়ের চাপে সর সর করে জাল তোলে। ঝুপ ঝুপ করে জাল থেকে পানি পড়ে। গাব দেয়া জালের বুকে পুটি টেংরা লাফাতে থাকে। কবির জাল টেনে টেনে সেগুলো ডুলায় ভরে। তারপর আবার বাঁশের খুঁটি ধরে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে আপনা আপনি উঠে যায় তার সিংহাসনে। তখন আবার জাল বিছিয়ে পড়ে পৌঢ়া খালটির বুক জুড়ে। বিকেলে হয়তো যা কিছু মাছ জমেছে তা নিয়ে মকবল বাজারে যায়। হয়তো তখন কবির ঘুরতে থাকে মকবলের পাছে। এমন সময় হয়তো মকবলের বড় মেয়ে আছিয়াও এসে আব্দার করে বাবার সাথে বাজারে যাওয়ার। কবির বুঝতে পারে, তার আর বাজারে যাওয়া হবে না। ভাবলেশহীন মুখে সে সেখান থেকে সরে পড়ে।
কবিরকে আবার দেখতে পেয়েছি দীর্ঘ সাতাশ বছর পর। তখন আমাদের জীবন থেকে কেটে গেছে অনেক বর্ষা। কেটে গেছে অনেক জ্যোৎস্না বিধৌত রাত। অনেক অমাবস্যা শেষে কবিরকে আবার পেয়েছি। সেবার আমরা গ্রামে গেলে প্রথম যে লোকটির সাথে দেখা হয় তাকে চিনতে বেশ বেগ পেতে হয়নি। সেই একই ভাবলেশহীন চিরচেনা কবিরের মুখ। কবির আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। -কী খবর? জিজ্ঞেস করে। আমিও কবিরকে কুশল জিজ্ঞেস করি। কবির তেমনি ভাবলেশহীন মুখে উত্তর দিয়ে চলে যায়। বিকেলে গ্রামের বাজারে হাঁটতে গেলে আবার কবিরের দেখা পাই। ডেকে চাখাইয়ে জিজ্ঞেস করি, -কবির ভাই, এতদিন কি গ্রামেই আছেন? -আরেনা! কবির বলে। সে ছিলো ঢাকা শহরে। মিস্টির দোকানে কাজ করে বোনদেরকে বিয়ে শাদি দিয়েছে। বাড়িতে নতুন ঘর তুলেছে। শুনলাম মকবল আর মকবলের স্ত্রী এখন তার উপরই নির্ভরশীল। খালে ব্রিজ হয়েছে, পৌঢ়া বৃদ্ধ হতে হতে মরে গেছে। সংসারের আয় রোজগার বলতে এখন তার ইনকামই। বললাম, -কবির ভাই, বিয়ে শাদী করেছেন? জীবনে এই প্রথম তার মুখে একটা লাজুক হাসি ফুটে উঠে। ডানে বামে মাথা দোলায়। জানালো, পিতা তাকে সম্পত্তির ভাগ দিতে চাইলেও চাচাতো ভাইয়েরা কিছুতেই দিবে না। তাদের এক কথা, -রক্তের কুনু সম্পর্ক নাই। কবির হাসে, -বুঝজেন, রক্ত, রক্তই অইলো আসল। আমি বললাম, আপনি যে তাদেরকে করছেন এরকি কোনো প্রতিদান নেই? কবির একগাল হাসে, Ñআমি তোকুনু বিনিময়ের জন্য করতাছিনা ভাই। টাকা জমাইলে আমিও একটা বাড়ি করতাম পারতাম। কামাইরটা কায় বইনেরারে বিয়া দিছি। চাইর চাইর জন বইন। এহন ওই বোনের জামাইরাও কয় আমি বলে কেউ না। কবিরের হাসির ফাঁকে কখন যে তার চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠে টের পাইনা। দেখি একটা ফোটা টলমল করছে কবিরের চোখে। মুখ ফিরিয়ে কবিরকে একটু আড়াল দিলাম, চোখের পানি মুছে ফেলার জন্য।