‘বনসাই প্রেম’ যেখানে আত্মীয়তার শর্ত!

317

প্রকৃতির বুক থেকে বিলুপ্তপ্রায় একটি গাছের দেখা মেলে বাড়ির ‘বেলকনি বা ড্রয়িং রুমে’। নাম তার ‘বনসাই’। বছরের পর বছর যত্ন করে শক্ত কান্ড রয়েছে এমন গাছের খর্বাকৃতি করার শিল্পকে বনসাই বলা হয়। প্রকৃতি আর গাছের প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে বনসাই চাষ সম্ভব নয়। তবে এ কঠিন শিল্পকে ভালোবেসে শখে পরিণত করেছে একটি পরিবার।
নগরীর পাহাড়তলী এলাকায় হাজী আলী আশরাফ সড়কের ‘খাঁন বাড়ি’। এ বাড়ির সবাই প্রকৃতির প্রেমে যুগের পর যুগ বনসাই চাষ করে যাচ্ছেন। এমকি প্রকৃতি ও বনসাইয়ের প্রতি ভালোবাসা আছে এমন পরিবার প্রাধান্য পায় খাঁন বাড়ির সাথে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরিতে।
গত রবিবার নগরীর কাজীর দেউড়িতে শুরু হয়েছে ‘সবুজ মেলা’। এর উত্তরপাশে রয়েছে ‘বনসাই ড্রিমস্’ স্টল। যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৫০ ধরনের বনসাই রয়েছে। ৫ থেকে ২৮ বছর বয়সী বনসাই স্টলটিতে বিক্রি হচ্ছে। এসব গাছের দাম ৫ হাজার থেকে ৩ লক্ষ টাকা। মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের আকর্ষণ ‘স্টলটিকে’ ঘিরে। কেউ কৌতুহল বশত গাছগুলো দেখছেন, আবার কেউ নিজের সাথে মিলিয়ে সেলফি তুলছেন।
শুধু তাই নয়, স্টলে উপস্থিত বনসাই ড্রিমস্’র কর্ণধার আবদুল্লাহ খাঁনের কাছে ছুড়ে দিচ্ছেন শত প্রশ্ন। তিনি উৎসাহের সাথে সবাইকে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন আর নগরজীবনে প্রকৃতি ও গাছ প্রেমের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এ যেন গাছের প্রতি মানুষের ভালোবাসার নিখাদ নিদর্শন।
স্টলটিতে বিভিন্ন বয়স ও দামের বনসাই রয়েছে। এরমধ্যে ২৮ বছর বয়সী পাকুড়ের দাম ৩ লাখ টাকা, ১৫ বছর বয়সী অর্জুন ২০ হাজার টাকা, ১০ বছরের চন্দন ১০ হাজার, ১২ বছরের চায়না বট ২০ হাজার, ৫ বছরের সৌদি খেঁজুর ১৩ হাজার, ১৫ বছরের তেঁতুল ২০ হাজার, ১৮ বছরের কদবেল ২৫ হাজার, ১০ বছরের কাট বাদাম ৪০ হাজার, ১০ বছরের হিজল ১০ হাজার,বছরের শিমুল ৩০ হাজার, ১৫ বছরের কালোজাম ২০ হাজার, ১৫ বছরের খিড খেঁজুর ১৫ হাজার, অশ্বথ ৫০ হাজার, ৬ বছরের আমপাতা বট ৫ হাজার, ১৭ বছরের কাঁঠালী বট ৪০ হাজার, ১০ বছরের পিঠাল ১০ হাজার, মহুয়া ২০ হাজার, ১৩ বছরের বকুল ৩০ হাজার, ১২ বছরের খৈয়া বাবলা ১৫ হাজার, ৫ বছরের সাদা চন্দন ৩০ হাজার, ৫ বছরের তুজা ৪০ হাজার ও ১২ বছরের দেশি শ্যাওড়া ৩০ হাজার টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব ছাড়াও আরও অনেক বনসাই রয়েছে স্টলটিতে।
বনসাই ড্রিমস্ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বনসাই ক্লাব চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ খাঁন বাবলু পূর্বদেশকে বলেন, আমি ব্যক্তিগত জীবনে ব্যবসা করি। তবে বনসাই আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা। এ ভালোবাসার জন্ম পরিবার থেকে। ছোটকাল থেকে দেখে আসছি, পরিবারের সবাই গাছ লাগাতেন। বাড়ির আশপাশ ও বারান্দায় নানা গাছ থাকত। সেই থেকে গাছের প্রতি আমার আকর্ষণ জন্মে। একদিন রাস্তার পাশ থেকে একটি পাকুড় গাছের বাকল সংগ্রহ করি। সেখান থেকে পাকুড় বনসাই চাষ শুরু করি। সেই গাছটির বয়স এখন ২৮ বছর। মেলায় যার দাম রাখা হয়েছে তিন লক্ষ টাকা। ২৮ বছর ধরে প্রতিদিন গাছটিতে দু’বার পানি দেওয়া ও নিয়মিত পরিচচর্যা করতে হয়েছে। পরিবারের সবাই বনসাইয়ের যত্ন নিতে ভালোবাসেন। তাই ব্যস্ত জীবনে কাজটি কঠিন হয়ে উঠেনি। ভালোবাসা আর ইচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব।
বনসাইয়ের প্রতি ঝুঁকলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বনসাই একটি শিল্প। প্রকৃতির বুকে সুবিশাল গাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সেসব গাছের চারা সংগ্রহ করে, খর্বাকৃতির করে রাখাকে বনসাই বলে। প্লেট আকারের পাত্রে এ গাছ রাখা হয়। যাতে বিলুপ্তপ্রায় প্রকৃতিকে মানুষ বাড়িতে, বেলকনিতে বা রুমে রাখতে পারে। তাছাড়া বনসাই চাষে আমার টান রয়েছে। তাই ওসব গাছ নিয়ে আমার জীবন। পরিবার থেকে গাছের প্রতি প্রেমের শিক্ষা পেয়েছি। আবার আমার চাচা এমডি জাকারিয়া, যিনি বনসাই ক্লাব চট্টগ্রামের সভাপতি। তার থেকে দেখেই বনসাই চাষে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ির ছাদে প্রায় ৬শ বনসাই রয়েছে। মেলায় ৫০টির মত আনা হয়েছে। বিক্রিটা মূল উদ্দেশ্য নয়। মানুষের মাঝে সবুজের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্টলটি দেওয়া। কেননা এক একটা বনসাই গড়তে সময় লেগেছে ৫ থেকে ২৮ বছর। এর পেছনে যে শ্রম ও সময় গেছে, তা কখনও টাকায় পরিমাপ করা যাবে না। সবার মাঝে বনসাইকে ছড়িয়ে দিতে চাই।
স্টলটিতে সবগুলো বনসাইয়ের গায়ে গাছের বয়স, নাম ও দাম লেখা আছে। তবে একটি বনসাইতে কোনকিছু লেখা নেই। তার কারণ জানতে চাইলে খাঁন বাবলু বলেন, বনসাইটির নাম ‘বেলবেট’। গাছটি খুবই দুর্লভ। পাওয়া যায় না। গাছটি বিক্রি করবো না। তাই গাছটিতে কোন কিছু লেখা হয়নি। এছাড়া কেউ যদি বনসাই চাষ করতে চান, তাহলে তাদের বিনামূল্যে ট্রেনিং দেওয়া হবে বলে জানান এ প্রকৃতিপ্রেমী।
স্টলে উৎসুক দর্শনার্থীকে গাছের বর্ণনা দিচ্ছিলেন বনসাই ক্লাব চট্টগ্রামের প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আত-তাওয়াবুল ইসলাম। তিনি অবশ্য খাঁন পরিবারের নাতী। তিনি বলেন, আমার নানুর পরিবারের সবাই বনসাই চাষ করেন। এখন সেটা আরও বেড়েছে। সবাই প্রকৃতির প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা থেকে শখের বসে এ শিল্পের চর্চা করছেন। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই।
বনসাইয়ের প্রতি পরিবারের ভালোবাসা বুঝাতে তিনি বলেন, আমাদের সাথে যখন নতুন কোন পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়, তখন দেখা হয় তারা প্রকৃতি ও গাছকে ভালোবাসেন কি না। অন্যদের চেয়ে যারা প্রকৃতিপ্রেমী তারা বেশি প্রাধান্য পান।
উল্লেখ্য, বনসাই মূলত শক্তকান্ড বিশিষ্ট গাছকে নান্দনিকভাবে খর্বাকৃতি করার শিল্প। গাছের গড়ন নির্ণয় থেকে শুরু করে তাতে পানি দেওয়া তথা বাঁচিয়ে রাখা এবং যে পাত্রে বা টবে তা চাষ করা হয়, তা নির্ধারণ এবং প্রতিস্থাপন সবই এর অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানি ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি। বনসাই করতে ব্যবহৃত ট্রের মত যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তাকেই সাধারণভাবে ‘বন’ বলা হয়। পাশ্চাত্যে পাত্রে খর্বাকৃতির গাছ বলতে ‘বনসাই’ বোঝায়।