বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ধুঁকছে নানা সংকটে

287

বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফআইডিসি) আওতায় আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ২২টি রাবার বাগান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও বাগানের বেশিরভাগই চট্টগ্রামে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৯ সাল থেকে রাবার উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করলেও এখন নানা সমস্যায় ধুঁকছে। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে গঠিত দুটি কমিটি তাদের প্রতিবেদনে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও উৎপাদন বাড়াতে বেশকিছু সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরেন।
প্রতিবেদন পেয়ে গত ২১ জানুয়ারি বিএফআইডিসি চেয়ারম্যান কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে আরো কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ী করেন বিএফআইডিসি চেয়ারম্যান।
পরিদর্শনকালে কর্মকর্তাদের কার্যক্রমে অসন্তুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ বনশিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সীমা সাহা বলেন, ‘বিএফআইডিসির আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বাড়াতে হবে। সবধরনের সমস্যা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করা হবে। কি মেশিন আছে, কি নাই এগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। সঠিকভাবে তথ্য দিতে হবে। যাতে আমার পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হয়। উল্টাপাল্টা কিছু এখানে আর চলবে না। খোঁড়া খোঁড়া রিপোর্ট দেয়া চলবে না।’
বিএফআইডিসি সূত্র জানায়, বিএফআইডিসির আওতায় ২২টি বাগান ছাড়াও কাপ্তাইয়ে লাম্বার প্রসেসিং কমপ্লেক্স (এলপিসি), কালুরঘাটে সাঙ্গু-মাতামুহুরী কাঠ আহরণ ইউনিট, ক্যাবিনেট ম্যানুফ্যাকচারিং, ফিডকো ফার্নিচার কমপ্লেক্স, কাষ্ঠ সংরক্ষণ ইউনিট (ডবিøউটিপি), তেজগাঁও ইস্টার্ন উড ওয়াকস, মিরপুর ক্যাবিনেট ম্যানুফ্যকচারিং প্লান্ট (সিএমপি), শ্রীমঙ্গলের রাবার কাঠ প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নামে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। ১৯৬০-৭০ সালের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
জানা যায়, গত বছরের ২১ অক্টোবর তিনটি প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের বিদ্যমান কাঠ প্রসেসিংয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও এর সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়। বিএফআরআই এর পরিচালক ড. খুরশীদ আকতারের নেতৃত্বে পাঁচজন কর্মকর্তা কাপ্তাইয়ে লাম্বার প্রসেসিং কমপ্লেক্স (এলপিসি), কালুরঘাট কাষ্ঠ সংরক্ষণ ইউনিট ও শ্রীমঙ্গলের রাবার কাঠ প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট পরিদর্শন করেন এবং গত ৪ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদনে প্রাপ্ত সুপারিশ ও মতামত বাংলাদেশ বনশিল্প কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে বিএফআরআই কর্তৃক প্রস্তুত ও দাখিলকৃত প্রতিবেদনের উপর চারজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত চার সদস্যের টিম ফিজিবিলিটি স্টাডি করে পুনরায় প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ছয়টি সমস্যা চিহ্নিত করে মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিএফআইডিসি’র প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টসমূহের বিদ্যমান কাঠ প্রসেসিং ক্ষমতা দ্বিগুণ করার ক্ষেত্রে তিনটি ইউনিটের সবগুলোতেই ট্রিটেমেন্ট সক্ষমতা পর্যাপ্ত রয়েছে। পক্ষান্তরে চেরাই কার্যক্রম (সয়িং ওয়ার্ক) অংশে স’মিল স্থাপন করতে হবে এবং সিজনিং কার্যক্রম অংশে সিজনিং চেম্বার স্থাপন আবশ্যক। শ্রীমঙ্গল রাবার কাঠ প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের বয়লারের ক্যাপাসিটি পর্যাপ্ত থাকায় এখানে আপাতত বয়লার স্থাপন অত্যাবশ্যক নয়। বাকি দুটি প্লান্টের বয়লার অতি পুরাতন হওয়ায় সিজনিং চেম্বার স্থাপনের পাশাপাশি বয়লার স্থাপন আবশ্যক।
কালুরঘাট কাষ্ঠ সংরক্ষণ ইউনিট ও কাপ্তাই লাম্বার প্রসেসিং কমপ্লেক্সে প্রস্তাবিত সিজনিং চেম্বারগুলো বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে নির্মাণ করতে হবে। এরমধ্যে কাষ্ঠ সংরক্ষণ ইউনিটে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় প্রায়শই উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এজন্য ভূমি উঁচুকরণের বিষয়টিও উঠে আসে। শ্রীমঙ্গল রাবার কাঠ প্রেসার ট্রিটেমেন্ট প্লান্টে মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতিসমূহ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে সচল রাখার জন্য একটি যান্ত্রিক কারখানা ও একটি কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাব স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে স’মেশিন, সিজনিং চেম্বার ও বয়লার যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটানো ইউনিটগুলোর দ্বারা সম্ভব না হওয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে এই ব্যয় নির্বাহ করার প্রস্তাবনা করা হয়।
কমিটিতেই মতবিরোধ : বিএফআইডিসি কর্তৃক গঠিত ফিজিবিলিটি স্টাডি কমিটিতে ছিলেন বিএফআইডিসি সদরদপ্তরের মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিক্রয়) আরমান হায়দার, বিএফআরআই কাষ্ঠ সংরক্ষণ বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তা আবদুস সালাম, বিএফআইডিসি এসএমপি ইউনিট প্রধান মো. হযরত আলী ভূঁইয়া, সহকারী ব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিক্রয়) অজন্তা দেব। গত ২১ জানুয়ারি বিএফআইডিসি কালুরঘাট কমপ্লেক্সে শিল্প প্রতিষ্ঠানের রাবার কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও আসবাবপত্র উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমস্যা, সমাধান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠকে বিএফআইডিসি চেয়ারম্যান সীমা সাহা ফিজিবিলিটি প্রতিবেদন নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পৃথকভাবে জানতে চান। এসময় কমিটিতে থাকা কর্মকর্তারা ভিন্নভিন্ন মতপোষণ করলে ক্ষিপ্ত হন চেয়ারম্যান। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভৎসর্না করেন। এসময় বিএফআরআই এর গবেষণা কর্মকর্তা আবদুস সালামের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মতামত দেন অন্যরা।
গবেষণায় অনভিজ্ঞ গবেষক: বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি) কর্তৃক গঠিত ফিজিবিলিটি স্টাডি কমিটির অন্যতম সদস্য বিএফআরআই এর গবেষণা কর্মকর্তা আবদুস সালাম। বনশিল্প কর্পোরেশনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান এলপিসির সমস্যা নির্ধারণে এ কর্মকর্তা কাজ করার কথা জানান। এসময় বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান প্রস্তাবনা পেশ করতে বললে তিনি এলপিসিতে কি কি যন্ত্রপাতি আছে তাও জানাতে পারেননি। একপর্যায়ে বিশেষজ্ঞ এই কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেন বিএফআইডিসি চেয়ারম্যান।
এ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বিএফআইডিসি চেয়ারম্যান এসময় বলেন, ‘সরকার কোটি কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় করছে। অথচ আপনারা পরিদর্শন না করে ঘরে বসেই প্রতিবেদন দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ হয়েছেন অথচ কিছুই জানেন না। আপনারা সব রিসার্চ করেন। এখনতো দেখি সব আমাদেরই বলতে হচ্ছে।’ এসময় গবেষণা কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, ‘প্রথমবার হওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে।’
এদিকে প্রতিবেদন ও গোলটেবিল বৈঠকে সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় বিএফআইডিসির মহাব্যবস্থাপক (রাবার বিভাগ) মকসুদুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি রাবার ইউনিট দেখভাল করি। আমার এখানে কোনো সমস্যা নেই। বাকি সমস্যাগুলো নিরসনে ঢাকা থেকে কাজ চলছে।’