বদলে যাচ্ছে ত্রিপুরাপল্লী

42

শত বছরের দুর্গম জনবসতি মোনাই ত্রিপুরাপল্লী। যেটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর উপজেলায় অবস্থিত। যোগাযোগ, বিশুদ্ধ পানি, শিক্ষাসহ সবদিকে পিছিয়ে ছিলেন ত্রিপুরাপল্লীর বাসিন্দারা। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে অসংখ্য জেলা কালেক্টরেট বা জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালন করে গেলেও অবহেলিত থাকার কারণে কেউ হাটহাজারীর ত্রিপুরাপল্লীতে যাননি বলে জানান এ পল্লীর বাসিন্দারা।
সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক হিসেবে এ পল্লীতে পদার্পণ করলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। তিনি ঘোষণা করেন ‘শহরের মত সব সুযোগ-সুবিধা এখানে প্রদান করা হবে। এ জনপদ আর অবহেলিত থাকবে না।’
গতকাল রবিবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সাথে আলাপচারিতায় এ ঘোষণার কথা জানান।
স্থানীয়রা জানান, ঠিক এক বছর আগেও বিদ্যুৎ, স্কুল, রাস্তা, সুপেয় জলসহ এখানে ছিল না কোন সুযোগ-সুবিধা। ছিল না কোন চিকিৎসাসেবা। এতদিন মনে হতো এ পল্লী প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। বিভিন্ন সময়ে নানা রোগে অনেক প্রাণ অকালেই ঝড়ে যেতো।
গত ২০১৮ সালে অজ্ঞাত রোগে একই পরিবারের তিনজনসহ মারা যায় চার শিশু। শিশু নিহতের ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলোয় আলোচনার ঝড় ওঠে।
অবহেলিত এ ত্রিপুরাপল্লীতে বাস করেন ৫৫ পরিবারের ৩৭৫ সদস্য। পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর, স্থানীয় এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জেলা ও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনসহ বেসরকারি অনেক সংগঠন এ পল্লীবাসীর কল্যাণে মানবিক সাহায্য প্রদানে এগিয়ে আসে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রধান সড়ক থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের আইলকে উন্নীত করা হয়েছে ১৫ ফুট প্রস্থের কাঁচা সড়কে। তৈরি হয়েছে আটটি কালভার্ট ও আটটি সেমিপাকা শৌচাগার। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা অর্থায়নে স্থাপন করা হয়েছে তিনটি গভীর নলকূপ, মন্দিরভিত্তিক স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম, নির্মাণ করা হয়েছে টিনশেড ঘর, ব্যবস্থা করা হয়েছে সৌর বিদ্যুত। আর এসব কিছুর পেছনে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। প্রত্যেকটি কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ রুহুল আমিনের মাধ্যমে তদারকি করতেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও প্রদান করতেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বলেন, ‘মোনাই ত্রিপুরাপল্লীর অবস্থান চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের হাটহাজারী ফরহাদাবাদ সড়ক থেকে পশ্চিমে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে। এমন একটি অজপাড়াগাঁয়ে আধুনিক নাগরিক জীবন বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন সেটি বদলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের আন্তরিক সহযোগিতায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ত্রিপুরাপল্লীর যাতায়াতের আইলটি সড়কে উন্নীত করেছি। এছাড়া শিক্ষাসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নও করা হয়েছে। আমি মনে করি, উন্নত যোগাযোগই হলো উন্নয়নের পূর্বশর্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকলে, সেখানে কোন কাজ সহজ হয় না।
ত্রিপুরাপল্লীর বাসিন্দা ও সর্দার শচীন ত্রিপুরা বলেন, কীভাবে বুঝাবো কেমন বেহাল অবস্থা ছিল আমাদের। কিন্তু গত এক বছর আর বর্তমানের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। এতদিন আমরা নাগরিক জীবনের সুবিধার বাইরে ছিলাম। এখন আমরা বিদ্যুৎ, সড়ক, নলকূপ, শিশুদের শিক্ষাসহ অনেক কিছু পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে অন্যান্য জনপদের মত সবকিছু পেয়েছি। আমাদের এখানে দেওয়া হয়েছে তিনটি সৌর বাতি এবং একটি মোবাইলে চার্জ দেয়ার পয়েন্ট। পুরো পল্লীতে মাত্র একটি চায়ের দোকান আছে, সেখানেও লাগানো হয়েছে সৌরবাতি। এখন ত্রিপুরাপল্লীর বাসিন্দারা অনেক খুশিতে আছেন এবং প্রশাসনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছেন।
গত শনিবার ত্রিপুরাপল্লীতে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত ‘জেলা প্রশাসক প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তি-২০১৯ প্রদান’ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। এ সময় তিনি ৬০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৬০ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, একশো বছরের পুরনো দুর্গম ত্রিপুরাপল্লীকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন বদ্ধপরিকর। মোনাই ত্রিপুরাপল্লী আর অবহেলিত থাকবে না। আগামী তিন চার বছরের মধ্যে ত্রিপুরাপল্লীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ শহরের মানুষের মতোই জীবনযাপনের সুযোগ পাবেন। আগে এখানে যাতায়াতের সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য স্কুল তৈরি করা হয়েছে। এসব জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন পথ দেখাবে।