বদলে যাওয়া ভুবনে টলমল শিশুরা

20

এই বছরই স্কুল শুরু হয়েছিল সাফিরের, ঢাকার মিরপুরের চারুপাঠ হাতেখড়ি স্কুলের প্লে-গ্রূপে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। কিন্তু শিক্ষক আর বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠতে না উঠতেই মহামারির ছোবলে এখন ঘরবন্দি শিশুটি। শুরুতে বোঝানো গেলেও এখন সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান সাফিরের মা। স্কুলে যেতে প্রতিদিনই তার কান্না সামলাতে গিয়ে অস্থির এখন তিনিও।
করোনা ভাইরাস মহামারিতে কয়েক মাসের ঘরবন্দি জীবনে সাফিরের মতো শিশুরা ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
মনোবিদ ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, অস্বাভাবিক এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কঠিন এই সময়ে শিশুদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অভিভাবকদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ছোঁয়াচে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও গত মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কবে তা খুলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই পরিস্থিতিতে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে চাইলেও তাতে অনভ্যস্ত শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকরাও। সাফিরের মা শাহরিন বুশরা জানান, সপ্তাহে ছয় দিন অনলাইনে এক ঘণ্টা করে ক্লাস হয় তার ছেলের। কিন্তু এ সময়টায় অনলাইনে তাকে রাখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম বোঝানো যেত, এখন একেবারেই মানতে চাচ্ছে না। অনলাইনে ক্লাস করাতে হচ্ছে জোর করে। সে এভাবে ক্লাস করবে না, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে একসাথে ক্লাস করবে।
সাফির বায়না ধরায় তাকে শান্ত করতে দুই-তিনবার স্কুলের সামনে থেকে ঘুরিয়েও এনেছেন তার মা। তার মূল্যায়ন, ‘সব বাচ্চা তো আসলে এক না। স্কুলে থাকতে শিক্ষক যা পড়াতেন, সব শিখে যেত বাসা থেকে। হোমওয়ার্ক করত নিজে নিজেই। কিন্তু এখন বাসায় পড়ালে সে মনোযোগ দিতে পারছে না, শিখতেও পারছে না’।
একই সমস্যায় পড়েছেন ফাতেমা আক্তার শাম্মি। তার জমজ দুই ছেলে আয়ান ও আয়মান মিরপুরের প্যারাডাইস কিন্ডারগার্টেন ও হাই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। শাম্মি জানান, বাসায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে তার ছেলে দুটি। অনেকদিন ধরেই তো আসলে বন্দি, কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। স্কুলে খুব যেতে চায়। একদিন টিচারকে ফোন করে কান্না করেছে স্কুল খুলে দেওয়ার জন্য। ওরা খেলাধুলা করতে পারে না, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পারে না, এসব বলেছে। পরে টিচার বুঝিয়েছেন।
শাম্মি জানান, তার এক সন্তান ক্লাসে দ্বিতীয় ও আরেকজন চতুর্থ হতেন। কিন্তু এই দীর্ঘ বিরতিতে তাদের পড়ার অভ্যাসে ফাটল ধরেছে। এটা কীভাবে পূরণ হবে তা নিয়েই দিশেহারা তিনি। তিনি বলেন, ‘বাসায় বেশিরভাগ সময়ই কার্টুন, মোবাইলে গেমস খেলতে চায়। পড়াতে হয় জোর করে। পড়াশুনায় আগের মতো আগ্রহ, মনোযোগ কোনোটাই নেই। ওদের সপ্তাহে একদিন অনলাইনে ক্লাস হয়, এতে আসলে তেমন কোনো লাভ হয় না’।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী অনন্যা ত্রিপুরা শ্রেয়ার মা ঝর্ণা ত্রিপুরা মনে করেন, আগে স্কুলে যাওয়ার ফলে চারপাশ থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ ছিল, যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাচ্চাদের নিরাপদ রাখতে বাসায় রাখছি। কিন্তু এতে সে জেলখানার মতো বন্দি হয়ে গেছে। সে বাইরে বেরুতে চায়, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চায়, স্কুলে যেতে চায়, মাঠে খেলতে চায়। কিন্তু সেটা তো এখন সম্ভব না। নানা কিছু দিয়ে ওকে বোঝাচ্ছি। কিন্তু কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে’।
মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের কেজির শিক্ষার্থী আরশিয়া আয়াত মর্তুজারও স্কুলে যাওয়ার বায়না। সাত বছর বয়সী আরশিয়া জানায়, ‘স্কুলে যেতে চাই। বন্ধুদের সাথে একসাথে ক্লাস করব, খেলবো, মিসের বকা খাব। কিন্তু তারপরও স্কুলে যাব। বাসায় একদমই ভালো লাগছে না। বোরিং লাগছে, টাইম কাটছে না’।
সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা করে অনলাইনে ক্লাস হয় আরশিয়ার। সেদিন বন্ধু আর শিক্ষকদের দেখলে ভালো লাগে, জানাল এই শিশু। আরশিয়ার বড় বোন প্রিয়ন্তি আরিয়া একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী, সপ্তাহে পাঁচ দিন তিন ঘণ্টা করে অনলাইনে ক্লাস করতে হয় তাকে। খবর বিডিনিউজের
প্রিয়ন্তি বলল, ‘টানা ক্লাস করতে খুব কষ্ট হয়। মাথা ব্যথা করে, অনেক প্রেসার লাগে। এভাবে ক্লাস করায় কোনো আনন্দ নেই। আগে ভাবতাম কবে একটু ছুটি পাব, আর এখন শুধু ওয়েট করছি কবে স্কুল খুলবে’।
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় শিশুদের সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, ‘একটি শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবার, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি তার কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে সে শিক্ষা পায় এখান থেকেই। তবে যেই ক্রান্তিকাল আমরা অতিক্রম করছি, তা শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য অন্তরায়’।
শিশুদের মানসিক বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য নতুন নতুন কৌশল খুঁজে বের করার জন্য অভিভাবকদের তাগিদ দিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক এই পরিচালক। তিনি বলেন, ‘মা-বাবারা এ বিষয়গুলোতে যদি সচেতন হয়, তাদের বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মেধা ও প্রযুক্তির দিক থেকে সচেতন হতে হবে। গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে’।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নিলুফার আক্তার জাহান মনে করেন, নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শিশুরা অনলাইনে ক্লাস না করে ঘরে বসে থাকলে সেটি আরও বেশি ক্ষতিকর হত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘শিশুদের অনলাইনে ক্লাসটা বা পড়াশোনাটা চালিয়ে নেওয়া একটা বিকল্প মাধ্যম। বিকল্প কখনও দীর্ঘস্থায়ীভাবে নিতে হলে, সেটা একটা বড় প্রভাব ফেলে শরীর ও মনের ওপর। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মতো মহামারিতে নিরাপদে থাকাটা অনেক বেশি জরুরি’।
শিশুদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এগুলো হচ্ছে- প্রতিদিন রুটিন করে বন্ধু, আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, প্রতিদিনকার রুটিনে বিনোদন, কাজ, যোগাযোগ, ঘুম, খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা- এ বিষয়গুলো থাকতে হবে, ডিভাইসের প্রতি আসক্তি কমাতে তাদের রুটিনমাফিক কাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
অধ্যাপক নিলুফার বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তাদের চিন্তার জায়গাটায় পজিটিভ বিষয় থাকতে হবে। প্রতিদিন তারা করোনাভাইরাসের বিষয় সচেতন হওয়ার জন্য জানবে, কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য। খুব বেশি জানা শুরু করলে মানসিক চাপ বাড়বে। চিন্তাধারায় বদল এনে পজিটিভ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশুনা, নাচ-গান, ছবি আঁকা, বাগান করা, সঠিক সময়ে খাওয়া, ঘুম, খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই তাদের মানসিক চাপমুক্ত রাখা সম্ভব’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, শিশুর সামাজিকীকরণটা মূলত শুরু হয় বাসা থেকে। স্কুলে পাঠদানের ফলে সেটা আরও বিকাশ লাভ করে, সে জায়গাটায় ক্ষতি তো হবেই। তবে এই সময়টায় পরিবার থেকে যদি শিশুর প্রতি যতœবান হওয়া যায়, তবে এই ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের শিশুদের প্রতি যতœবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে অনলাইনে সময় কাটানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, তবে খেয়াল রাখতে হবে অতিরিক্ত সময় যেন তারা নষ্ট না করে। বেশি সময় কাটালে তাদের আসক্তি তৈরি হবে, সেটা করা যাবে না’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজি বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার মনে করেন, এই সঙ্কটকালে কিশোর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় বাবা-মারা বলেন, তারা বাচ্চাদের বন্ধু। কিন্তু এটা কখনোই হয় না। বন্ধু হলে সেটা সমবয়সী কেউ হতে হয়। কারণ সমবয়স হলে একে অপরের সাথে একটা বিষয় শেয়ার করার ফলে শেখা হয়। বাচ্চারা যখন বাসায় থাকছে, তখন তারা বড়দের সাথে বা ছোটদের সাথে সময় কাটাচ্ছে। তারা সমবয়সীদের পাচ্ছে না, এতে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি একই সঙ্গে বলেন, ‘শুধু নেতিবাচক দিকই আমি বলব না। কিছু বাচ্চা হয়ত ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। তবে বন্যা হলে যেমন পলিমাটি দিয়ে যায়, সেটা সারের কাজ করে; ঠিক তেমনি বাচ্চারা যখন বিপদে পড়ে, কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়, তখন নিজস্ব সামর্থ্যরে মাধ্যমে তারা তা রিকভারি করে যায়’।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ মনে করেন, প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুটো দিক থাকলেও মহামারিকালে শিশুদের নাগালে প্রযুক্তি আসায় তা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে সম্ভাবনাও হতে পারে।
প্রতি বছর বিদেশি পরামর্শকদের পেছনে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘জনবহুল এই দেশে কাজের মানুষের অভাব। মনে রাখতে হবে, যেখানেই সংকট সেখানেই সম্ভাবনা। আগে তো প্রতিদিন যানজটেই দিনের তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নষ্ট হত, সেটা এখন হচ্ছে না’।
অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, ‘শিশুদের ইতিবাচক সংস্কৃতিতে অন্তঋর্ণক্ত করতে হবে। তাদের হাতে ডিভাইস চলে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু অভিভাবকদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। করোনা ভাইরাসের সময়ে যদি এই শিশুরা হারিয়ে যায়, তাহলে তাদের ভোগান্তিই বেশি হবে। তাই পড়াশুনা যেন বিঘিœত না হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে তাদেরই। অভিভাবকরা তাদের মানবিক মূল্যবোধ শেখাবে’।