বদলে গেছে নির্বাচনী প্রচারণার ধরন-কৌশল

382

প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বমোট দশ কোটি দুই লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় চার কোটি ভোটার এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকরা অতীতের মত নির্বাচনে শুধু ভোটারদের বাড়ি কিংবা বাসায় গিয়ে তাদের মন জয় করার কৌশলে আর ভরসা রাখতে পারছেন না। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও হাতে গোনা হওয়ায় প্রার্থীদের কাছে গণসংযোগের পাশাপাশি অন্যতম প্লাটফর্ম হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে অনলাইন ও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্যাণে প্রথাগত প্রচারণার ধারণায় এসেছে নতুনত্ব। তাই এবার নির্বাচনী প্রচারণার ধরন ও কৌশল পাল্টে গেছে।
এদিকে এবারের নির্বাচনী প্রচারণার আরেক নতুনত্ব হচ্ছে, দুই বড় রাজনৈতিক জোটের হয়ে দেশের তারকা কণ্ঠশিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়দের ব্যাপক হারে গণসংযোগসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর সম্প্রচারমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে তারকাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যাপকভাবে অংশ নেয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। জোট বা দলের হয়ে নির্বাচনী পথসভায় ভোটও চাইছেন তারা।
নির্বাচন-পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জনজীবনের অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচার তাই আর কেবল অফলাইনের আঙিনায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারছে না। অনলাইনে, ডিজিটাল মাধ্যমে তাই প্রচারের প্রবণতা বেড়েছে প্রতিদ্ব›দ্বী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা জোটের প্রার্থীদের। দলগত প্রচারণা ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীদের অনেকেই এবার অনলাইন প্রচারণার কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় তাৎক্ষণিক প্রচার সম্ভব বলে যে কোনো মুহূর্তে প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও তোলা যায়।
ফলে, এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় সম্প্রচার বা গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বড় প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। প্রধান দুটি দলসহ সবগুলো রাজনৈতিক দলই এবার ভোটের বাজারে প্রচারণার হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। সাধারণ মানুষের হাতে হাতে শোভা পাওয়া মোবাইল ফোনে চোখের পলক না পড়তেই চলে আসছে অটো ফোন কল, বাল্ক এসএমএস কিংবা ভিডিও ক্লিপস।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হচ্ছে চলতি পথে ঘটে চলা আলোচিত বিভিন্ন ঘটনার মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ভিডিওচিত্র। যা রেখাপাত করছে সাধারণ ভোটারদের মনে। এছাড়া দল কিংবা জোটের পক্ষ থেকে সাধারণ ভোটারদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে নির্মিত ছোট ছোট বিজ্ঞাপন চিত্র কিংবা রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতির অডিও-ভিডিও ক্লিপস।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইন ঘুরে দেখা গেছে, ভার্চুয়াল লড়াইয়ে বড় দুই দল বা জোটের এমপি প্রার্থীর অনুসারী বা সমর্থকরাই বেশি এগিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে নৌকা আর ধানের শীষের জমজমাট লড়াই চলছে। শুধু পোস্টার বা ছবি প্রকাশ করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না। প্রার্থীদের বিগত দিনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলোও পোস্ট আকারে প্রচার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্যও করছেন অনেকে। এছাড়াও প্রার্থীদের প্রতিদিনের প্রচারণা, বিভিন্ন সভা ও গণসংযোগের লাইভ ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনগুলোর ভোটারদের মোবাইল নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছে ভোট চাওয়া হচ্ছে। অটো ফোন কলের মাধ্যমেও পাঠানো হচ্ছে অডিও বার্তা।
এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, ‘লন্ডন কিংবা ভারতের বিগত নির্বাচনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশেও এবার নির্বাচনী প্রচারণায় মোটামুটি প্রযুক্তির প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া যেমন- ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডিন, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপি, ভাইবার, ইমো ইত্যাদির মাধ্যমেও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চলছে। রাজনীতিবিদরা ভিডিও কনফারেন্সের মত বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এছাড়া সমাজে সব মানুষের কাছে সমাদৃত যে ব্যক্তিরা রয়েছেন, তাদের ধারণকৃত সংক্ষিপ্ত ভিডিও ক্লিপস, ইউটিউব ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে বিভিন্ন প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।’
গুজব ঠেকাতে মনিটরিং : নির্বাচনকে সামনে রেখে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ছবি জুড়ে দিয়ে ‘গুজব’ সৃষ্টির অপচেষ্টা ঠেকাতে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়সহ সর্বত্র মোবাইল যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার পাশাপাশি ইন্টারনেটের পূর্ণমাত্রার গতি বজায় রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত ২৬ নভেম্বর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), মোবাইল অপারেটর টেলিটক, গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে অনুষ্ঠিত নির্বাচনোত্তর বৈঠকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অ্যাপ : আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী অ্যাপ চালু করেছে আওয়ামী লীগ। গত ১৫ ডিসেম্বর চালু করা অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক এই অ্যাপ এর নাম রাখা হয়েছে সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সাব-কমিটি বা সংক্ষেপে এসটিএসসি। এই অ্যাপ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা নিজেদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান, নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক, সাধারণ এলাকাভিত্তিকসহ পুরো বাংলাদেশে একে অপরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারবেন। সেন্ট্রালাইজড নেটওয়াার্ক এবং কমন প্লাটফর্মের মাধ্যমে দলের প্রয়োজনে কোন খবরকে ভাইরাল করা এই অ্যাপের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানান আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন কমিটি-২০১৮ এর আওতাধীন তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক কমিটির সভাপতি মোস্তফা জব্বার।