বঙ্গমাতা : মুক্তির অনির্বাণ শিখা

5

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

নিবন্ধের প্রারম্ভেই জাতীয় কবি নজরুলের ‘নারী’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘সাম্যের গান গাই-আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রæবারি অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।/ নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা করে নারী হেয়-জ্ঞান?/ তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।’ বঙালির হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত পরম শ্রদ্ধার মহীয়সী নারী বঙ্গমাতার ক্ষেত্রে কবি নজরুলের উল্লেখ্য পংক্তিসমূহ জীবনচরিত পরিচর্যায় কতটুকু প্রযোজ্য তা সহজেই অনুমেয়। ভারতের প্রয়াত মাহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র ও জনগণের অকৃত্রিম অভিভাবক শ্রী প্রণব মুখার্জী মহোদয়ের ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এশিয়া অন্যরকম হতো’ নিবন্ধের নিন্মোক্ত উদ্বৃতি নিবিড় প্রণিধানযোগ্য। ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করলেও বাঙালিত্ব কখনো ভুলতে পারি না। রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে এ প্রথম একটি বাংলা বইয়ের গ্রন্থাগার তাই গড়ে উঠেছে আমার আমলে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বহু পুস্তক রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে হলে এ গ্রন্থটি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল। আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসাবে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া আমার প্রথম শিক্ষা।’
বিশ্ব ইতিহাসের অবিসংবাদিত কিংবদন্তী জাতীয়তাবাদী নেতা বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক এই ধরিত্রীর মূল্যায়ণে অবিনশ্বর ত্যাগ-মহিমার কঠিন যন্ত্রণাদগ্ধ যেসব দলিল প্রণীত হয়েছে তার অন্যতম দুটো গ্রন্থ হচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দি হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বার বার এই দু:সহ নি:সঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও আপোস করেন নাই। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নাই। তাঁর জীবনে জনগণই ছিল অন্ত:প্রাণ। মানুষের দু:খে তাঁর মন কাঁদত। বাংলার দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন-এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিকে বীর হিসেবে বিশ্বে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে বিশ্বে এক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল করেছেন।’
উক্ত লেখায় জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর বিশাল রাজনৈতিক জীবন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তিনি যা দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অসাধারণ সংগ্রাম, অধ্যাবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়েছেন তার সংগৃহীত পান্ডুলিপির ইতিবৃত্ত করুণ গৌরবগাঁথায় লিপিবদ্ধ করেছেন। এই মহামূল্যবান লেখনীর পিছনে এবং বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা এবং দেশকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে কর্মকৌশল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমৃত্যু যিনি অমিত প্রেরণার উৎসসূত্র ও ছায়াসঙ্গী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহধর্মিণী বাঙালির বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ডাক নাম ‘রেণু’ খ্যাত এই অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নিগূঢ় রাজনৈতিক অণুবীক্ষন-প্রজ্ঞা-মেধা-যোগ্যতা মানদÐে অপরিমেয় ও অতুলনীয় অবদান বিশ্বস্বীকৃত।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সূচনায় প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য হলো, ‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখ”। সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।” আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। দিন তারিখ সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে, তবে ঘটনাগুলি ঠিক হবে বলে আশা করি। আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু-আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চার্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হয়। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ২০৪ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শাস্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার ফিরে এসে বললেন, “এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে।” আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, “অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি।” ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “কাউকে খবর দিতে হবে কিনা? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম করবেন?” বললাম, “দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না।” আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়েদি ছিল, আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠাÐা হয়ে যাচ্ছিল।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তাঁর কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বার বার আব্বা, মা, ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেণুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কি হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোট ভাই ওদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলছিলাম। হাচিনা কামালকে একবার দেখতেও পারলাম না।’
স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ পরিপ্রেক্ষিত রচনায় অত্যন্ত মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ রাজনৈতিক নেতার মতই বলিষ্ট ও দৃঢ়চেতা সংগঠক হিসেবে বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থা ও বিশ্বাসের জ্ঞায়পিতা সহধর্মিণী। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শবাদী চিন্তা-চেতনার অনুপ্রাণিত আশ্রয়স্থল। বঙ্গমাতা ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাস্তায় রাস্তায় নিজ হাতে লিফলেট বিতরণ করেছিলেন। তিনি আন্দোলনকালীন সময় নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের আত্মীয়স্বজনদের নিজ বাড়িতে আপ্যায়নসহ শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের আর্র্থিক সাহায্য করতেন। অনেক সময় নিজের স্বর্ণালংকার বিক্রি করেও সংগঠনের চাহিদা মিঠিয়েছেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধ সূত্রে অবহিত হয়েছি; কীভাবে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণকে কালোত্তীর্ণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম ভাষণের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মা সোজা আব্বাকে বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারাজীবন আন্দোলন করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, সেই কথা বলবা। অন্য কারও কোনো কথা বলার দরকার নাই। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন কি না, সে নিয়ে সে-সময় নানা জিজ্ঞাসা ছিল। আর এই সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতিও ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেন পরোক্ষভাবে আর সেটি বুঝতে পারেনি পাকিস্তানিরা। এই বক্তৃতায় একটা ভুল যদি হতো, লাখ লাখ মানুষ সেদিন শহীদ হতো।’ সম্পূর্ণ অলিখিত ও ফুটনোট ছাড়া বিরল এই ভাষণ বিশ্বনন্দিত হয়েছে একমাত্র বঙ্গমাতার করণেই।
জননেত্রীর উল্লেখিত এবং পরবর্তী উদ্বৃতি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা এবং বাংলাদেশ একরৈখিক মাত্রায় যে সমার্থক, সম্পূরক ও পরিপূরক, নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘কী অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন চলত তা তিনি বুঝতেন, কিন্তু আমার মায়ের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। ……আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যত বার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন। আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযতেœ রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না। বারবার মায়ের কথাই মনে পড়েছে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় বঙ্গবন্ধু যেমন চিরঞ্জীব; অমর ও অক্ষয়, ঠিক একইভাবেই তাঁর নিরলস আত্মত্যাগ ও দুরূহ জীবন প্রবাহের পিছনে বঙ্গমাতার যে অবদান তাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
দেশের খ্যাতিমান বরেণ্য বুদ্ধিজীবী প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ রচিত ‘নারীদের নারীরা : নারীদের উপন্যাসের নারীভাবমূর্তি’ প্রবন্ধ অনুসারে বলা যায়, “পুরুষ নারীর সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাস করে নি কখনো, আজো সন্দেহের চোখে দেখে নারীর সমস্ত সৃষ্টিকে; সাধারণত তাকে স্বীকৃতি দেয় না, বা দেয় নিজেরই স্বার্থে। বাঙলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এক বিদেশিনী, হেনা ক্যাথরিন মুলেন্স, যিনি ফুলমণি ও করুণার বিবরণ নামের একটি উপন্যাস-খসড়ায় নারীদের দিতে চেয়েছিলেন খ্রিষ্টীয় করুণার শিক্ষা, পুরুষের ছক অনুসারে ঢালাই করতে চেয়েছিলেন নারীদের। বাঙালি নারীরা যখন প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করে, তখন পুরুষ এ কাজকে অনাচার বলেই গণ্য করে। আজো বাঙালি পুরুষ তাদের সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে নেয় নি। সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘দীপনির্বাণ’ উপন্যাসটি পুরুষের প্রথম উদ্যোগের দু-দশকের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে ছিন্ন মুকুল, বিদ্রোহ, ¯েœহলতা, ফলের মালা, হুগলীর ইমামবাড়ী ইত্যাদি। এছাড়াও অনরূপাদেবী ও নিরুপমা দেবী’র দিদি, বিধিলিপি, শ্যামলী, মন্ত্রশক্তি, মহানিশা, মা, গরিবের মেয়ে, পথহারা, ত্রিবেণী অন্যতম।” ভার্জিনিয়া উল্ফ্ বলেছিলেন, ‘উপন্যাস নারীর একান্ত শিল্পাঙ্গিক, বাঙালি নারীরা তাঁর কথাকে অনেকখানি সত্যে পরিণত করেছে।’
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে জীবন-জীবিকার অনন্য প্রবাহ থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা এখনও চলমান। এঙ্গেলস এর ভাষায়, ‘পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রতিষ্ঠা স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়; পুরুষ গৃহস্থালির কর্তৃত্বও দখল করল, স্ত্রীলোক হল পদানত, শৃঙ্খলিত, পুরুষের লালসার দাসী, সন্তানসৃষ্টির যন্ত্র মাত্র। বিয়ে মোটেই স্ত্রী ও পুরুষের সদ্ভাব সূত্রে দেখা দেয় নি, দেখা দেয় নারী পুরুষের একজন কর্তৃক অপরের উপর আধিপত্য হিসেবে। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রী-ই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে…..বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে বিত্তবান শ্রেণীগুলির মধ্যে পরুষই হচ্ছে উপার্জনকারী, পরিবারের ভরণপোষণের কর্তা এবং এইজন্যই তার আধিপত্য দেখা যায়, যার জন্য কোন বিশেষ আইনগত সুবিধা দরকার পড়ে না। পরিবারের মধ্যে সে হচ্ছে বুর্জোয়া; স্ত্রী হচ্ছে প্রলেতারিয়েত।’ কিন্তু উল্লেখিত ধারণাসমূহের প্রবলতাকে উৎপাটন করে বঙ্গমাতা একজন কৃতি নারী হিসেবে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় জীবনচরিত নির্মাণে পরিপূর্ণ সফল ও সার্থক প্রমাণ করেছেন। ইচ্ছা ও আগ্রহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্তরের শক্তিকে পরাভূত করার মত নারী জাগরণের বিকল্প পন্থার পরিগ্রহতাকে বঙ্গমাতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
স্বাধীন মাতৃভূমির দীর্ঘ সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণ বিসর্জনে ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রসারমান উপত্যকায় বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতোই অকুতোভয় নির্ভীক যোদ্ধা এবং নিরন্তর লালসবুজের পতাকা উড্ডীন ও সমুন্নত রাখতে আত্মত্যাগেও পিছুপা হন নি। বিশ্বকবি রবীঠাকুরের ‘নারীর উক্তি’ কবিতার পংক্তি ‘মিছে তর্ক-থাক্ তবে থাক, কেন কাঁদি বুঝিতে পার না?/ তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই মুছিলাম আঁখি,/ এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা\/…… দীপ জ্বেলে দীর্ঘ ছায়া লয়ে বসে আছি সন্ধ্যায় ক’জনা,/ হয়তো বা কাছে এস, হয়তো বা দূরে বস,/ সে-সকলই ইচ্ছাহীন দৈবের ঘটনা\/ এখন হয়েছে বহু কাজ, সতত রয়েছ অন্যমনে।/ সর্বত্র ছিলাম আমি, এখন এসেছি নামি-/ হৃদয়ের প্রান্তদেশে, ক্ষুদ্র গৃহকোণে\’ অত্যন্ত হৃদয়বিদারক মিনতিরাশির উল্লেখ্য উজ্জীবন চন্দ্রাতপ আচ্ছাদনে চিরঅ¤øান-চিরঅমর-অক্ষয় আলোকরশ্মি বিতরণে জাতিকে যেকোন দু:সময়ে রাজসিক পথপ্রদর্শনে অমিয় উপমা হিসেবে সমাদৃত থাকবেন – নি:সন্দেহে এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করা যায়। শোকাবহ মাস হলেও বঙ্গমাতার জন্মদিনে অজ¯্র শ্রদ্ধায় চৈতন্য-নৈবেদ্য নিবেদন করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি