বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ও স্বাধীনতা

45

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতিজাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সাল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বস্তুতপক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এটি সুষ্পষ্ট যে, ৭ মার্চ বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে একটি অনন্য সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ অবিনস্বর দিন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এই ভাষণ শুধু অগ্নিঝরা মার্চকে কেন্দ্র করে নয়; দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে অভূতপূর্ব দিক নির্দেশনার সুনিপুণ ক্রোড়পত্র। ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাঙালি জাতিরজনক নয়; এ ধরিত্রীর সকল শোষণ-বঞ্চনা-পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির অন্যতম ত্রাতা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
দেশে-বিশ্বে বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-লেখক-রাজনীতিক কবিতা, সাহিত্য, গান ও রচনায় অভিনব সৌকর্যের মোড়কে বর্ণিল উপমায় বঙ্গবন্ধুকে মহাকালের মহানায়ক অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন। বরেণ্য কবি ও লেখক অজয় দাশ তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু: আদিগন্ত যে সূর্য’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে চিত্রায়িত করার কয়েকটি পংক্তি উচ্চারণ করতে চাই – ‘বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া/ থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া/ সুর-অসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া/বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া/ …. বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম বিশ্বশ্রেষ্ঠ হওয়া ও অতুলনীয় গৌরবগাঁথার প্রণিধানযোগ্য কারণ বিশ্লেষণ অতীব জরুরী। ভাষণের পটভূমি, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের নির্মম বেড়াজাল এবং সর্বোপরি দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অমিয়-তেজোদীপ্ত বাণী-নির্দেশনাসমূহ হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত করা না গেলে মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক পাঠোদ্ধার, যথার্থ অনুধাবন ও উপলব্ধিতে ধারণ করা নিতান্তই কষ্টকর।
২০১৩ সালে জ্যাকব এফ. ফিল্ড এর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘WE SHALL FIGHT ON THE BEACHES – THE SPEECHES THAT INSPIRED HISTORY’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশটি ভাষণের এক অনবদ্য সংকলন। বইটির নামকরণে সম্পাদক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের এক উল্লেখযোগ্য বাক্য ব্যবহার করেছেন। যখন জার্মানির হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোলান্ড এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিলে নরওয়ে দখলে নেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলিকে হিটলারের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগে বাধ্য করে চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। অল্প বিরতিতে ফ্রান্সসহ হিটলারের অন্য দেশ দখলের জন্য Nazi বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ১৯৪০ সালের ৪ জুন চার্চিল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘We shall fight on the seas and oceans, we shall fight with growing confidence and growing strength in the year, we shall fight on the beaches,… We shall fight in the fields and in the streets and …, we shall never surrender’। অনুরূপ চেতনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে দীপ্রকন্ঠে বজ্রকঠিন উচ্চারণে বলেছিলেন ‘আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।’
উল্লেখিত গ্রন্থে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭’র রোনাল্ড রিগেনের ভাষণসহ মোট একচল্লিশটি বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের The Struggle This Time is the Struggle for Independence ভাষণটি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাষণের মধ্যে ছিল : 431 BC Funeral Oration- Pericles, 326 BC Address at Hydaspes River- Alexander the Great, 48 BC Address before the Battle of Pharsalus- Julius Caesar, 1453 The Final Stand- Emperor Constantine XI, 1653 Dismissal of the Rump Parliament- Oliver Cromwell, 1716 Speech to the Council of Perth- James Francis Edward Stuart, 1783 The Newburgh Address- George Washington, 1805 Speech Before and After the Battle of Austerlitz- Napoleon Bonaparte, 1862 Blood and Iron- Otto von Bismarck, 1865 Second Inaugural Address – Abraham Lincoln, 1917 An Appeal to the Read Army- Vladimir Lenin, 1917 War message to Congress- Woodrow Wilson, 1940 We Shall Fight on the Beaches- Winston Churchill, 1941 A Date Which Will Live in Infamy- Franklin D. Roosevelt, 1941 Address on the Anniversary of the October Revolution- Joseph Stalin, 1944 Serve the People- Mao Zedong, 1945 Declaration of Independence- Ho Chi Minh, 1973 Farewell to the Nation – Salvador Allende

বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠাতা ও সফল রাষ্ট্রনায়কদের যেসব ভাষণ বিশ্ববাসীকে করেছে নির্ভীক প্রাণিত ও প্রতিশ্রুত, সব ভাষণই ছিল সম্ভবত লিখিত ভাষণ। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। লিখিত তো নয়ই, কোন ধরনের ফুটনোট বা স্ক্রিপ্ট দেখে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ প্রদান করেন নি। দৃপ্তকন্ঠে নির্মাল্য অসাধারণ কাব্যিক ভঙ্গিমায় দেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ অন্দোলন পরিচালনা এবং চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের সার্বিক কৌশলপত্র নির্দেশিত করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতির পিতা স্ব স্ব দেশের জনগণকে জাতিরাষ্ট্র উপহার দেওয়ার যৌক্তিক পটভূমি তৈরিতে অবদানঋদ্ধ হয়েছেন। রাশিয়ান জাতির পিতা প্রথম পিটার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, মেক্সিকোর মিগুয়্যেল হিডালগো, উরুগুয়ের জোসে গার্ভাসিও অর্টিগাস, চেক প্রজাতন্ত্রের ফ্রান্টিসেক প্যালাকি, আধুনিক চীনের সান ইয়াত সেন, ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইয়ো প্রমুখের জীবন ও রাষ্ট্রদর্শন যেমন বিশ্বকে পথ দেখিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর অত্যুজ্জ্বল অবস্থান অতিশয় দিগ¦লয় এবং প্রমিত।
এটি সর্বজনবিদিত যে, ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পাঁচটি প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ উভয় পরিষদেই একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দু:খজনকভাবে জুলফিকার আলী ভূট্টোর ঘোষণা ছিল- ‘গত তেইশ বছর পূর্ব পাকিস্তান দেশ শাসনে ন্যায্য হিস্যা পায়নি, তাই বলে আগামী তেইশ বছর পাকিস্তানের উপর প্রভুত্ব করবে তা হতে পারে না।’ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক এবং ভূট্টোর দলের কূট অপকৌশলের নগ্ন ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেও ১লা মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আহবানে ১ মার্চ থেকে সারা দেশে চলমান ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলনে স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও উত্তাল মিছিল-¯েøাগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলে। ৩ মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বীর শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব না।’ মার্চের দিনপঞ্জির অনুক্রমিক আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
দেশবাসী সম্যক অবগত ছিলেন যে; ২৮ জানুয়ারি ১৯৭১ ভুট্টোর সাথে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী আলোচনা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে অযৌক্তিক কূটচক্রের আড়ালে ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা মূলত: পাকিস্তান সামরিকজান্তার অপশাসন অব্যাহত রাখার গভীর ষড়যন্ত্রের বহি:প্রকাশ মাত্র। বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে কদাচার-পাপাচার-ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তাঁর প্রজ্ঞা-তীক্ষ বিচক্ষণতায় আগাম অনুভব এবং সে অনুসারে প্রায়োগিক পরিকল্পনা গ্রহণে পারদর্শী-দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রকৃতঅর্থেই বাঙালি জাতি-সত্ত্বার উম্মেষ ঘটিয়ে দীর্ঘ অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত পর্যায়ে অর্জিত স্বাধীনতাকেই অর্থবহ আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করেন। বিশ্বের অতুলনীয় জনপ্রিয়তা ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত অন্ধ, নিঃস্ব-দরিদ্র গায়ক মহাকবি হোমার সর্বকালের শীর্ষ ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ গ্রীক মহাকাব্য রচনা করে অদ্যাবধি যেমন অম্লান রয়েছেন, ৭ই মার্চের কালোত্তীর্ণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বিশ্বইতিহাসের অধ্যায়ে চিরঅম্লান ও চিরসম্ভাষিত থাকবে – দৃঢ়চিত্তে এটি বলা যায়।
দেশপ্রেমে কালোত্তীর্ণ মহাপুরুষ এবং বাঙালি মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসায় প্রণীত বঙ্গবন্ধুমানস বাঙালির দু:খ-দুর্দশার প্রকৃত বেদনা-যন্ত্রণা যথার্থ হৃদয়াঙ্গম করতে পারতেন। প্রাসঙ্গিকতায় অসহযোগ আন্দোলন চলাকলীন পর্যায়ে দেশের জনগণ যাতে বঞ্চনার শিকারে পরিণত ও খাদ্য-অর্থ কষ্টে পর্যুদস্ত হয়ে না পড়েন; সে সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। সরকারি কর্মচারীদের বলি : আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবে না। শোনেনÑমনে রাখবেন, শত্রæবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবেঙলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।
চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু মেধা ও মননে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সাবলীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সচলতাকে পরিপুষ্ট করেছিলেন। উল্লেখ্য সাহসিক পরিক্রমায় জাতিকে সুনির্দিষ্ট পন্থায় এগিয়ে নিয়েছিলেন বলেই প্রতিষ্ঠিত গণভিত্তির জন্য অনুপন্থিতি সত্তে¡ও তাঁরই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীনতা অর্জনে সার্থক হয়েছিল। রণকৌশল এবং রণনীতি কি হবে এবং কিভাবে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে; তাতেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল – ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব – তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্যসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এসেছেন কিন্তু এমন করে কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেন নি। তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ভারতের মহাতœা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুসাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর অবদানের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের এক অনিবার্য স্থানে যথার্থই অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। এটিও সত্য যে, ইন্দোনেশিয়ায় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ড. আদম মালিক নয়, মহান স্বাধীনতার সংগঠনের জন্য জাতির পিতা হিসেবে সুকর্ণই প্রতিষ্ঠিত।
বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়েনা, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ১৯৭৫ এর ২৮ আগষ্ট তারিখে লন্ডনের ‘দি লিসনার’ পত্রিকায় বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন এর ভবিষ্যতবাণী- ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনেই অবস্থান করবেন। তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্মারক-চিহ্ন’ এবং কবরস্থানটি ‘পূণ্যতীর্থে’ পরিণত হবে’। আজ এটি অতিসার্থকতার সাথে বিশ্বব্যাপী সত্যবাণীতে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক আবুল ফজলের ভাষায়, ‘শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও’। নিবন্ধের কোথাও কোন বিষয় পুনরোল্লেখিত হয়ে থাকলে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ এবং পাঠকের ক্ষমা-সুন্দর মনোযোগ প্রত্যাশা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী
সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়