বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় মৌলভী সৈয়দকে হত্যা করা হয়

72

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর রাত। এই দিনে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। সেসময় দেশে অত্যন্ত ভীতিকর-বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এমন প্রতিকূল পরিবেশে মৃত্যুকে পরোয়া না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ডাক দেন এবং ছাত্র যুবকদের সংগঠিত করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন। তিনি হলেন চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ। যাকে বঙ্গবন্ধু আদর করে মৌলভী বলে ডাকতেন।
এই তরুণ সংগঠক হত্যার প্রতিবাদে গোপন মিশন শুরু করেছিলেন। অনেকগুলো সফল অপারেশনও পরিচালনা করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিলেন। যখন প্রতিবাদ আন্দোলনের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে সেনা সরকারের রোষানলে পড়েন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এরপর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে জনতার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন মৌলভী সৈয়দ। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন, তখন মৌলভী সৈয়দসহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেন। ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মৌলভী সৈয়দকে ১নং ও মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ২নং আসামি করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতাকর্মীকে মামলা-১, মামলা-২ এবং মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তখন তারা ছিলেন ভারতে নির্বাসিত।পরবর্তীতে ভারতে জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর দল পরাজিত হলে মৌলভী সৈয়দ ও তার সহকর্মীদের ভারতীয় পুলিশ বাহিনী আটক কর ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশে প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দসহ তার অনেক সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জায়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে তাকে অমানষিক নির্যাতন করা হয়। অবশেষে ১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট সেখানেই বিনাবিচারে মৌলভী সৈয়কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সেই সময়ে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, ভয়ে এ হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। ভয়ে পরিবারের লোকজন দীর্ঘদিন গোপনে জীবনযাপন করেছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও এ নিয়ে নেতারা কোনো উদ্যোগ নেননি। এতে হতাশায় দিন পার করেন শহীদ পরিবারের লোকজন। বর্তমানে এই হত্যাকান্ডের ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো বিচারের দাবিতে নিবৃত্তে কাঁদছে পরিবারটি। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে আসে বারবার। শোকসভা, সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মৌলভী সৈয়দের বীরত্বগাঁথা। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ ৪৪টি বছর। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছেন না কেউ।
দীর্ঘদিন পর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু তার হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌলভী সৈয়দের হত্যার বিচার আজও হয়নি। এখন তার পরিবারের দাবি, অবিলম্বে মৌলভী সৈয়দ হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হোক।
মৌলভী সৈয়দ পরিবারের সন্তান জয়নাল আবেদীন বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর মৌলভী সৈয়দ সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ যুবকদের একত্র করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে খন্দকার মোস্তাক ও মেজর জিয়ার কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি জানান। এরপর থেকে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র প্রধান আসামি করে সৈয়দকে তৎকালীন স্বৈর সরকারের পুলিশ ও সেনা সদস্যরা খুঁজতে থাকে। তৎকালীন স্বৈর-সরকারের সেনারা আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায় ১৭ বার অভিযান চালায়। এরপরও বাপ-চাচাদের না পেয়ে বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। এমনকি চট্টগ্রাম শহরে যেখানে ভাড়ায় বাসা নিয়ে থাকতেন সেখানেও বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হন সেনা সদস্যরা। অবশেষে ১৯৭৭ সালে ১১ আগস্ট গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, আমার চাচা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তখন আমাদের ওপর দিয়ে কী অমানুষিক নির্যাতন গেছে তা বলার ভাষা নেই। আর আমাদের পরিবার এখানো নানাভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। তবুও সরকারের কাছে আবেদন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মতো প্রিয় চাচার হত্যাকারীদেরও বিচার করা হোক।
এ মহান বীর ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ বাঁশখালীর শেখেরখীল লালজীবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে পুঁইছড়ি ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে আলিম পাস করে পরবর্তী ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এর দুই বছর পর চট্টগ্রাম শহরের সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল কলেজটি। সিটি কলেজ থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৮ ও ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধু মৌলভী সৈয়দকে ‘আমার মৌলভী সাহেব’ বলে ডাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে লালদীঘির মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর কুজকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হয়। শহীদ মৌলভী সৈয়দ উত্তোলন করলেন বাংলাদেশের পতাকা আর মহিউদ্দিন চৌধুরী উত্তোলন করলেন জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা। অনলবর্ষী এই বক্তা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক কিংবদন্তী নেতা সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম শহরে প্রায় অর্ধশতাধিক সফল অভিযানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।