বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কমিশন গঠন করে পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করা জরুরি

4

ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আসিফ

[বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন বিশেষজ্ঞদের যে শক্তিশালী টিম কাজ করেছে সেই টিমের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আসিফ। চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাসিন্দা সাবেক সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমেদের ছেলে তিনি। অ্যাডভোটে আনিসুল হকের (বর্তমানে আইনমন্ত্রী) জুনিয়র হিসেবে থাকার সুবাদে তিনি ২০০৬ সালে এ মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন। রায় হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে এই মামলার কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক এ মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকাটাকে নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তবে তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিল মামলায় তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা পরিকল্পনাকারী ছিলেন, যারা এখনও দম্ভ করে বেড়ান জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে তাদের খুঁজে বের করা উচিত। প্রয়োজনে কমিশন গঠনের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার যে কলঙ্ক তিলক বাঙালির কপালে লেগে আছে তা পুরোপুরি মুছবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী। চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র আইনজীবী যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। ওই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা, অর্জনসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এর চুম্বুকাংশ এখানে তুলে ধরা হল- বি.স।]
১.
২০০৬ সাল থেকে আনিসুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ করতাম। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ এ যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার লিভ টু আপীল শুনানি শুরু হল তখন কোন রকম অফিসিয়ালি নিয়োগ ছাড়াই এ মামলার সঙ্গে যুক্ত হই। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের এই জঘন্য হত্যা; যেটা বাংলার ইতিহাসের একটি স্থায়ী কালো দাগ সেই হত্যার বিচারের সাথে যুক্ত হতে অফিসিয়াল চিঠির অপেক্ষা করিনি। যার সর্বোচ্চ ত্যাগের কারণে বাংলাদেশ সেই মহামানবের হত্যার বিচারের মামলায় কাজ করা একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমার কর্তব্য। তবে ২০০৯ সালে আপীল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ শুনানির সময় স্পেশাল র‌্যাঙ্ক-জি হিসেবে অফিসিয়ালি সরকারীভাবে নিয়োগ পাই।
আমাদের টিমের প্রধান এবং নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এছাড়া টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসহ অনেকে। তবে আমি ছিলাম টিমের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য এবং আমার জানা মতে চট্টগ্রাম থেকে আমি ছিলাম এই মামলার আইনজীবী প্যানেলের একমাত্র সদস্য।
আপীল বিভাগে শুনানি শুরু হয় ৫ অক্টোবর ২০০৯ এবং ২৯ কার্য দিবস ধরে শুনানি হয়। ২৯ দিন শুনানির পর মাননীয় আপীল বিভাগ আসামিদের আপীল খারিজ করে চূড়ান্ত রায় দেন এবং ১২ জনের ফাঁসির আদেশ দেন।
বিচার কার্যক্রশ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন শুনানির পর আমরা রাতে মামলার জন্য রিসার্চ এবং সাবমিশন তৈরি করতাম পরের দিনের জন্য। এমনও হয়েছে রিসার্চ করে সাবমিশন তৈরি করতে করতে ভোর ৪ টা হয়ে যেত। পরের দিন ঠিক সকাল ৮ টায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হাজির হতাম। যেহেতু বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবীর মূলত সাবমিশন দেন আমার কাজ ছিল মামলার সকল রিসার্চ, কেস-রেকর্ড এর ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান রাখা- যাতে তাৎক্ষণিকভাবে মাননীয় বিচারপতিদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়। এ ছাড়াও কোর্টের কাছে পেশ করার জন্য সব সাবমিশন আনিসুল হক স্যারের পরামর্শ মোতাবেক তৈরি করাই ছিল অন্যতম কাজ।
২.
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলা থেকে বড় কোনো মামলা আমার জীবনে নয় কেবল বাংলাদেশে কোন আইনজীবীর জীবনেই আসবে না। জাতির জনকের হত্যা মামলাতে সম্পৃক্ত হতে পেরেছি- নিজের কাছে এটাই ছিল আমার জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন। আইনের দিক থেকে বললে বলতে হবে ফৌজদারি আইনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এ মামলায় জড়িত ছিল। তাই আমাদের টিমের লক্ষ্য ছিল আসামি পক্ষ যে সকল গ্রাউন্ডে আপীল করেছে সে সকল গ্রাউন্ড খন্ডনের জন্য আমাদের উপমহাদেশসহ ইংল্যান্ড এর কোর্টে যে কেস ল (case law) আছে সেগুলোর ব্যাপারে অবহিত থাকা এবং মাননীয় বিচারপতিগণের বিবেচনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পিকচার দাখিল করা। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় চেয়েছেন একটি ন্যায়বিচার। তিনি চাইলে আলাদা ট্রাইব্যুনাল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেন নি। তিনি প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চেয়েছেন। তাই আমরাও আমাদেও সাবমিশন- এ কোন রকম ফাঁক-ফোকর বা ত্রুটি রাখতে চাইনি। আমরা কিছু কিছু ইস্যুতেত ২০০/২৫০ বছর অর্থাৎ ১৮০০ সালের ‘কেস- ল’ মহামান্য আপীল বিভাগে দাখিল করি।
৩.
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক এবং দেশের ভিতরে বহু ষড়যন্ত্র হয়। প্রায় ২২ বছর তো ইনডেমনিটি আইনের মত একটি কালো আইন দিয়ে খুনিদেরকে অব্যাহতি দিয়ে রেখেছিল। তাই হুমকি-ধামকি আসবে সেটা জেনেই মামলা পরিচালনায় একজন কনিষ্ঠ আইনজীবী হয়ে যুক্ত হই। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আর তার ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলা পরিচালনা করব; এটার জন্য কেউ হুমকি-ধামকি দিবে- এটা আমি কেয়ার করি নি। আমাদের টিমের অনেকই হুমকির শিকার হই। তাপস ভাইয়ের ওপরতো বাংলার বাণীর অফিসের বাইরে বোমা হামলা হয়। আমরা পিছপা হই নি। আমার চিন্তা ছিল একটাই, যে দায়িত্ব পেয়েছিলাম সেটা যেন পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারছি কিনা।
৪.
আমার জানামতে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো, আইন, পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বাকি ৫ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে; বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইনের কারণে খুনিদের ফিরিয়ে আনটা সময়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে। তবে এটা সত্য যে এদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে কার্যকর না করলে এরা যে কোন সময় ছোবল মারতে পারে। তারা দেশের বিরুদ্ধে সব সময়ই ষড়যন্ত্র করে যাবে।
৫.
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের বিচার হয়েছে। কিন্তু যারা পরিকল্পনাকারী ছিল, অন্তরালে ছিল তারা বিচারের বাইরে রয়ে গেছে। আমি মনে করি তাদের নাম উন্মোচন করা এখন সময়ের দাবি। এটা করার জন্য ট্রুথ কমিশনের আদলে একটা কমিশন করে এদের নাম জনসমক্ষে উন্মোচন করা উচিত। তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। আমরা জানি খন্দকার মোশতাক বা জিয়াউর রহমান জিবীত না থাকার কারণে তাদেরকে মামলার আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু এখনও অনেকে জীবিত আছেন এবং দম্ভ করে বলেন, যে তারা ঘটনার সময়ও জিয়াউর রহমানের বা জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ট ছিলেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা ছাড়া জিয়াউর রহমান কোন সিদ্ধান্ত নিতেন না। ষড়যন্ত্রকারী ও পরিল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে কমিশনে গঠনের ব্যাপারে ইতিপূর্বে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিশন এখনও হয় নি। এটা খুব শিঘ্রই গঠন হওয়া দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে যাদের মাধ্যমে সত্যটা উদঘাটিত হবে তারা অনেক বয়স্ক এবং তাদের জবানবন্দি সত্য উদঘাটনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এদের জবানবন্দী ছাড়া কমিশন সফলতা পাবে না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডর অন্তরালে কারা ছিল এটা পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা এখনও জানাতে পারি নি। পূর্ণাঙ্গ সত্য জানাতে এবং ভবিষ্যতে ইতিহাস বিকৃত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝতে হবে কেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল; কারা করেছিল। বিশ্বের অন্য কোন দেশে এরকম জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটে নি- যেখানে শুধু রাষ্ট্রনায়ককে নয়; তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়। মহাত্মা গান্ধি হত্যার বিচার করতে লেগেছিল মাত্র ৮ মাস। অথচ সেখানে আমাদের জাতির জনকের হত্যার বিচার করতে লেগেছে ৩৫ বছর।
[ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শহিদুল্লাহ শাহরিয়ার]

লেখক : সহকারী এটর্নিজেনারেল-বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা,
সদস্য-কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপকমিটি
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ