বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ – করোনাকালে নীরব বর্ষপূর্তি

49

ড. ইফতেখারউদ্দিন চৌধুরী

১২মে ২০১৮ বাংলাদেশের জন্য গৌরবের এক নতুন মাইল ফলক সূচিত হয়েছিল। ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশ জয় করে বিরল সম্মান অর্জনের মাধ্যমে উড্ডীয়মান বিশ্ব ইতিহাসে নবতর অধ্যায় রচনা করেছে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র। চৌকোস জাগরণে প্রজ্বলিত দীপ্যমানতার সম্মিলন ঘটিয়ে লাল-সবুজ পতাকায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নামফলক শোভিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপিত হয়েছে এমন এক অত্যুজ্জ্বল যুগান্তকারী স্থান থেকে, তথা কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯-এ লঞ্চ কমপ্লেক্স যেখান থেকে ১৯৬৯ সালে আমেরিকার এ্যাপোলো-১১ মহাকাশযান চাঁদে পৌঁছে দিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তানকে। এই যেন এক কল্পনা বিলাসির কল্পলোকে ভাসমান কোন ভেলা।
এতদিন এই ধরিত্রীর বুকে ‘বাঙালির বঙ্গবন্ধু-বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’ নামের যে অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা নানা উচ্চারণে সম্বোধিত ছিলেন, তিনি আজ মহাকাশেও তাঁর সেই বিশাল ব্যক্তিত্বকে জ্ঞাপিত করেছেন। প্রাণঘাতি করোনার মহাক্রান্তিকালে দেশের এই মহান অর্জনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি শুধু স্মরণেই উদযাপিত হয়েছে কালজয়ী ১২ মে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত বিশ্ব-সভ্যতার ইতিহাসে বর্বরতম প্রক্রিয়ায় রাজনীতির পটপরিবর্তনে পরাজিত শক্তি এই ধারণা পাকাপোক্ত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল যে তারা বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সার্থকতার সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। তাদের উপলব্ধিতে এটি হয়ত স্পষ্ট ছিল না- ইতিহাস-বাস্তবতা এবং সত্যের কঠিন বহিঃপ্রকাশ কখনো রুদ্ধ করা যায় না।
বর্তমান বাংলাদেশ তারই উজ্জ্বল উদাহরণ। দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত এ স্বাধীন- সার্বভৌম বাংলাদেশ হয়েছিল প্রচÐ নেতিবাচক বিশেষণে চরম আক্রান্ত। বিশ্ব পরিমÐলে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, অনৈতিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, মঙ্গা, মানবাধিকারলঙ্ঘন, জঙ্গী-মৌলবাদ, কুপমন্ডুকতা, অনাধুনিকতা ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যতম সভ্যত বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বিরূপ পরিচয়ে মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে এই; জাতিরজনকের সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান করোনা যুদ্ধ জয়ে অকৃত্রিম ও নিরলস প্রচেষ্টায় সার্বিক সফল তার সম্ভাবনায় দেশবাসীকে করেছে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক সকল নিয়ামক বিবেচনায় উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত হলেও করোনা অর্থনীতি কতটুকু সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রকে নির্মল্য রাখবে – তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে গরিব-দুঃখি-দিনমজুর-শ্রমিক-কৃষক এবং সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকার সচলতাকে বহমান রাখার জন্য প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা জাতির জন্য পরম পাওনা। শিল্প-ব্যবসা-কৃষিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব অবশ্যই অনেকটা নির্ভাবনার প্রযোক্তা হবে। এক কোটি মানুষকে ত্রাণ ও অর্থ বিতরণের মাধ্যমে দুর্বিষহ জীবন-যাপনের প্রলম্বিত করোনাকলে মানবতার প্রলিপ্ত দৃষ্টান্ত হবে- নিঃসন্দেহে তা বলা যায়।
২০০৮-২০০৯ সালে দেশের কোন মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যে ইডিজিটাল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে। দেশবাসী অবগত আছেন যে, এই মহৎ কর্মযজ্ঞের পিছনে যার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনি হলেন জাতিরজনকের সুযোগ্য জামাতা বিশ্ববরেণ্য পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং দেশরতœ শেখ হাসিনার যোগ্যতম পুত্র খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়। এক প্রচÐ কৌতুহল ও আবেগের স্ফুলিঙ্গ দেশের মানুষকে ১০ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তাড়িত করছিল এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য পর্যবেক্ষণে অধীর অপেক্ষা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় উৎক্ষেপণ স্থলে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিমন্ত্রী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ ৪২ জনের প্রতিনিধি দল। শেষ মুহূর্তে নির্ধারিত সময়ের সামান্য আগে উৎক্ষেপণ স্থগিত হওয়ার প্রাক্কালে অতিশয় সংশয়ে ব্যাকুল বিশ্বের সকল বাঙালি এবং অপেক্ষায় থাকা জনগণকে খুব দ্রæততম সময়ের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি চমৎকারভাবে অবহিত করার কারণেই বক্ষামাণ উৎসাহে বাঙালি নতুন করে প্রণিত হলো। উৎক্ষেপণের শেষ মুহ‚র্তগুলো কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং হিসেবে যদি একটু এদিক-সেদিক পাওয়া যায়, তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে, বিষয়টি অনেকেরই জানা ছিল না।
নির্ধারিত সময়ের ঠিক ৪২ সেকেন্ড আগে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে স্পেসএক্স সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পর দিন একই সময়ে অর্থাৎ ১২ মে আবার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহবহনকারী রকেটটি উৎক্ষেপণের চেষ্টা চালিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে যথাযথ ভাবে সার্থকতার সাথে উৎক্ষেপণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেন ‘এটা নিয়ে কারও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইনশা আল্লাহ স্যাটেলাইট অবশ্যই উৎক্ষেপণ হবে। বঙ্গবন্ধু – ১ স্যাটেলাইট আকাশে যাবে।
আমরা এও জানি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের প্রভূত সাহায্য সহযোগিতা করলেও তারাও ছিল অনেকটা অসচ্ছল এবং শক্তি-সম্পদের দিক থেকেও অনেক পিছিয়ে। তারা এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সর্বধিক প্রধান্য দিয়ে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে এবং মঙ্গলগ্রহে রকেট পাঠিয়ে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়াচার-পাঁচ দশক আগে উন্নয়ন মানদন্ডের প্রায় আমাদের মতই ছিল। কিন্তু তাদের অধিকতর দ্রæততর সাফল্যের পিছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান অনস্বীকার্য।
আমাদের হয়তো অনেকের জানা যে, ১৭৬০-১৮৬০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটনের ফলে বিরাজিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক বলয়ে বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। ১৮৮৪ সালে আরনল্ডটয়েনবী প্রণীত ‘Lectures on the Industrial Revolution in England’ গ্রন্থটি দ্রুততর পরিবর্তন পটভূমিকে বিশ্বব্যাপি পরিচিতি দিয়ে ছিল। বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার, যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষ করে রেলপথের উন্নতি এই পরিবর্ততের বিকাশমান তাকে অধিক ত্বরান্বিত করে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব বলতে আমরা বুঝে থাকি বিদ্যুতের আবিষ্কার এবং ব্যবহার যা উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে উন্নয়নের এক প্রযুক্তিগত ধারা সৃষ্টি করেছে। একই শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে কম্পিউটার আবিষ্কার, বিপনন ইত্যাদি বিশ্বয়ানের সূচনাকে নবতর অধ্যায়ে উন্নিত করে। সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিতে বস্তুগত সংস্কৃতিকে এগিয়ে এবং অবস্তুগত সংস্কৃতিকে পিছিয়ে নেওয়ার পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা অনেক বেশি সমালোচিত ছিল, তবুও এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কেন্দ্র ও প্রান্তিক দেশ সমূহের মধ্যে একটি আপেক্ষিক ভারসাম্য রক্ষায় এই তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের তাৎপর্যও উদ্ভাবন সভ্যতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল। শুরু হলো একবিংশ শতাব্দীর নতুন অভিযাত্রা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে তথ্য প্রযুক্তির নবনব উদ্ভাবন এবং অপব্যবহারের প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানবিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ যাকে এক কথায় বলা যায় ডিজিটাল বাংলাদেশ-ডিজিটাল বিশ্ব।
যে চারটি মৌলিক ধারণাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত করা হয়েছে তা হল: ক) কানক্টিং বাংলাদেশ খ) দক্ষ মানবসম্পদ গ) ই- গভর্নমেন্ট এবং ঘ) ইন্ডাস্ট্রি প্রোমোশন। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ সাল দেশে প্রথমবারেরমত জাতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে যেসব উদ্যোগ সমূহকে গুরুত্বসহকারে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু মহাকাশ জয় নয় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহারকে সমৃদ্ধকরণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে নগর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপনের সকল মঙ্গল নিশ্চিত কল্পে এটি আরো অধিকতর এগিয়ে যাক এটিই প্রত্যাশিত। আজ স্যাটেলাইট ১ এর সকল সুবিধা বিভিন্ন বেতার, টিভি সম্প্রচার, ইন্টারনেটসহ তথ্য প্রযুক্তির সামগ্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম, ভোটার আইডি, জন্মনিবন্ধন, ডিজিটাল ব্যাংকিং বৈচিত্র্য দিগন্তের স্বরূপ উন্মোচন এবং স্যাটেলাইট- ২ উৎক্ষেপণের ঘোষণা ও প্রস্তুতি করোনা ভারাক্রান্ত জাতিকে বৈভাষিক আশা সঞ্চারণে স্বয়ম্ভু ভূমিকা পালন করে চলেছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়