বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে আনোয়ারায় বাড়ছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড

97

খালেদ মনছুর, আনোয়ারা

বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় বাড়ছে অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক নানান কর্মকান্ড। উপজেলার প্রধান প্রধান সড়কের দুই পাশে চলছে আবাসিক-বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক। টানেলের আশপাশ ঘিরে শতাধিক ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানা, তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল কারখানা, রি-রোলিং মিল, ফিলিং স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। জনবহুল পয়েন্টগুলোতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখা খুলছে পাল্লা দিয়ে। বর্তমানে ২০ টিরও অধিক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা রয়েছে আনোয়ারায়। যা আগামি কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধশত ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় তৈরি হচ্ছে সড়ক নেটওয়ার্ক। মহাসড়কের পাশাপাশি ব্যাপকহারে আঞ্চলিক সড়কগুলোও প্রশস্তকরণের কাজ চলছে। দেশের স্বনামধণ্য শিল্প মালিকদের নজরও এখন আনোয়ারায়। এখানে শিল্প-কারখানা স্থাপন, আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, অবকাঠমোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ কড়া নাড়ছে দরজায়। এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ইউনিটেক্স গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপগুলো ব্যাপকহারে মিল-কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে জমি ক্রয় করছে আনোয়ারায়। ফলে গত পাঁচ বছরে বঙ্গবন্ধু টানেলের আশেপাশের জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। চাতরী চৌমুহনী বাজার, কারাবিবির দীঘির মোড়, কমিউনিটি সেন্টার ও আনোয়ারা সদরে সড়কের পাশে প্রতি শতক জমি এখন ৫০ লক্ষ টাকার উপরে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। যা কয়েক বছর আগেও বিক্রি হতো ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকায়।
এছাড়া কোরিয়ান ইপিজেড আগের চেয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এখন অর্ধশত নিজস্ব কারখানায় ৩০ হাজারের মত শ্রমিক কাজ করছে। ইতোমধ্যে কোরিয়ান ইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে বিদেশি নামীদামী কোম্পানীগুলো। চায়না ইকোনমিক জোনের কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারো শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে করা চুক্তি বাতিল করে চায়না রোডস অ্যান্ড ব্রীজের সাথে নতুনভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। চায়না ইকোনমিক জোনে স্থাপন করা হবে ৩৭১টি বিভিন্ন ধরণের কারখানা। যেখানে ২ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সবমিলিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় চলছে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মযজ্ঞ।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড় টুইন সিটি হবে। কক্সবাজার পর্যন্ত কানেকটিভিটি বাড়বে। উন্নয়ন হবে; কর্মসংস্থান বাড়বে। পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্রই পাল্টে যাবে। তবে যেখানে সেখানে মিল-ইন্ডাস্ট্রি করা যাবে না। আনোয়ারায় দুইটি ইকোনমিক জোন আছে। সেখানে করবে। যদি আরো লাগে সরকার আরো করবে।
জানা যায়, গত কয়েক বছর আগেও আনোয়ারা-কর্ণফুলীর মানুষ কল্পনা করতে পারেনি এতটা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন আর সক্ষমতা অপেক্ষা করছে এই জনপদে। চট্টগ্রাম শহরের অতি সন্নিকটে থেকেও দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল আনোয়ারা-কর্ণফুলী। আর এর প্রধান কারণ ছিল চট্টগ্রাম শহর আর আনোয়ারার মাঝখানে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদী। বর্তমানে এই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল আনোয়ারাকে পরিচিত করে তুলছে সারাদেশসহ বিশে^র দরবারে। প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এই টানেল আগামি ডিসেম্বরে চালু হলে চীনের সাংহাইয়ের আদলে গড়ে উঠবে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে দু’টি শহর।
এদিকে শিল্প কারখানা স্থাপনে প্রধান প্রয়োজনীয় তিন উপাদান গ্যাস পানি বিদ্যুৎ। আনোয়ারায় ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এলাকায় পানি সরবারাহের জন্য ওয়াসার পানির পাইপ লাইনের কাজ শেষ পর্যায়ে। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) মহেষখালী সমুদ্র বন্দর থেকে তিনটি পাইপ লাইনের মাধ্যমে আনোয়ারার উপর দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। আনোয়ারার বৈরাগে স্থাপন করা হয়েছে এলএনজি’র সাব-স্টেশন। সেখান থেকে আগামিতে আনোয়ারায় গ্যাসের আবাসিক এবং বাণিজ্যিক সংযোগ প্রদান করা হবে। আনোয়ারায় ইউনাইটেড গ্রুপ পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করছে। পিডিবিও কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাজ করছে। সবমিলিয়ে কল-কারখানা স্থাপনের জন্য প্রধান তিনটি উপাদানের যোগান নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না শিল্প মালিকদের। ফলে আনোয়ারা টুইন সিটিতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।
টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় গড়ে তোলা হচ্ছে সড়ক নেটওয়ার্কও। টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত কাফকো ইন্ডাস্ট্রি ঘেঁষে মাঝের চর এলাকায় বের হয়ে সংযোগ সড়ক দিয়ে মিলবে আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের সাথে। সেখান থেকে ক্রসিং-পটিয়া হয়ে কক্সবাজর ও চট্টগ্রাম শহরে চলাচল করবে। এছাড়া আনোয়ারা-বরকল-চন্দনাইশ হয়েও কক্সবাজারে যাবে টানেলের গাড়ি। ফলে পিএবি সড়ক ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় লেন এবং আনোয়ারা-বরকল সড়ক ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুটে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। এছাড়া চাতরী চৌমুহনী থেকে সিইউএফএল পর্যন্ত সড়ক চারলেনে, কমিউনিটি সেন্টার থেকে বন্দর পর্যন্ত সড়ক চারলেনে উন্নীত করা হচ্ছে। এগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সড়ক, বাইপাস সড়ক নির্মাণ করে টানেলকে ঘিরে তৈরি হওয়া যানবাহনের চাপ নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হচ্ছে এই সড়ক নেটওয়ার্ক। যার ফলে আনোয়ারাকে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে গড়ে তুলতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশ^মানের করতে এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছে সড়ক ও সেতু বিভাগ।
এদিকে টানেলকে ঘিরে নতুন নতুন কল-কারখানা স্থাপনে প্রচুর পরিমাণে বাড়ছে নারী পুরুষের চাকরির সুযোগ। এসব কল-কারখানায় নিয়োগ দেয়া হবে কয়েক লাখ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক। যার ফলে আনোয়ারায় থাকবে না বেকারত্বের সমস্য। বর্তমানে শুধুমাত্র কোরিয়ান ইপিজেডের ৩০ হাজার শ্রমিকের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি মাসের ৫ তারিখে আনোয়ারার কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে জমা হয় ১০ কোটি টাকার উপরে। এই টাকাগুলো হাত বদল হয়ে আনোয়ারার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। আনোয়ারায় শতাধিক কল-কারখানা, কয়েকটি ইকোনমিক জোন পুরোদমে চালু হলে প্রতি মাসে কয়েক লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতাই আসবে কয়েকশত কোটি টাকা।
এগুলো ছাড়াও টানেল এলাকার মানুষের প্রধান একটি আয়ের মাধ্যম হচ্ছে ফ্ল্যাট-বাসা ভাড়া। আনোয়ারায় কল-কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি বাসা-ভাড়ার ক্রম বর্ধমান চাহিদা বাড়ছে ব্যাপক হারে। কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় একটি এক রুমের সেমিপাকা বাসার ভাড়া আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ভালমানের বহুতল ভবনের একেকটি বাসার ভাড়া ১০ থেকে-১২ হাজার টাকা। যা বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন ভবন মালিকরা।
আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও নবনির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য এস এম আলমগীর চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারায় যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলছে উদ্বোধনের পর তা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে মানুষ আনোয়ারায় বাড়ি-ঘর নির্মাণ করবে। আনোয়ারা এক সময় চট্টগ্রাম থেকেও সুন্দর শহরে পরিণত হবে।
কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে আনোয়ারা-কর্ণফুলীসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম শহরে পরিণত হবে। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ব্যবসায়রাীরা। ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। মানুষের জীবন-যাত্রায় বৈচিত্র আসবে। পাল্টে যাবে এ অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক চিত্র।