বঙ্গবন্ধু : চিরন্তন প্রেরণার উৎস

49

শাকিল আহমেদ

বঙ্গবন্ধুর বড় কৃতিত্ব তিনি বাঙালিজাতির কৃষক, মজুর, শ্রমিক, যুবক থেকে সর্বসাধারণকে একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণের মধ্যদিয়ে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে যখন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পতনের মধ্যদিয়ে বাংলার শেষ সূর্য অস্তমিত যাচ্ছিল কতিপয় বৃটিশ সেনাপতির হাতে তখন কিন্তু বাঙালির কৃষক, শ্রমিক, যুবক ও সাধারণ মেহনতি মানুষ বুঝতে পারেনি তারা কী হারাতে যাচ্ছে। বুঝতে পারেনি বলেই ক্ষেতে-খামারে শ্রমজীবী মানুষ সেদিন তাদের স্ব-স্ব কর্মে মেতেওঠে ছিলেন। তাদের মনে ধারণা ছিল রাজা যাবে রাজা আসবে, রাজদরবারের পরিবর্তন ঘটবে, তাতে তাদের ভাগ্যের আর কী পরিবর্তন হবে। সুতরাং শেষ সূর্য অস্তমিতের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সর্বনাশ কিন্তু সেদিন তারা অনুধাবন করতে পারেনি। অপর দিকে এই সাধারণ জনগোষ্ঠীর হৃদয়-তন্ত্রীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল, জাগ্রত করতে পেরেছিল, মনোবল তৈরি করতে পেরেছিল বলেই সর্বসাধারণ একাত্তরের যুদ্ধে যাপিয়ে পড়েছিল। এবং এই সাধারণ মানুষের সতধারার অংশগ্রহণের ফলেই স্বশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতি তার বিজয় গাঁথা ছিনিয়ে এনেছিল। আর এই স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষন-
“…..যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক।…..”
সাতই মার্চের বক্তৃতা শুনলেন প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান আট মার্চ বেতারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসে। তার আত্মজীবনী ‘আমার একাত্তর’ এ এই ঐতিহাসিক ভাষণের অনুভূতি ব্যক্ত করেন এ ভাবে-“ কী অসাধারণ ভাষণ! সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন ‘ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’ তখন মনে হলো, পৃথিবীর বুকে একটি নতুন জাতির জন্ম হলো।”
আমাদের একালের অন্যতম সমাজচিন্তক একুশে পদক প্রাপ্ত আবুল মোমেন তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ-এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিজের মতো করে প্রকাশ করেন অর্ধশত বছর পর এসে এভাবে -“ এই অসামান্য ভাষণটি আমার বিবেচনায় এক কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম। শিল্পকর্ম কারণ এতে একটি জাতির সংগ্রাম ও স্বপ্নকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। ফলে একটি শিল্পকর্মের মতোই এটি হয়ে উঠেছে অমর, অনিরশেষ, এর স্বাদ বার বার নেওয়া যায়। নতুনতর বাস্তবতায় এর নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরী হয়। আজ এ- ভাষণটি কেবল শিল্পকর্ম নয় , কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম।” (সূত্রঃ কালি ও কলম, বঙ্গবন্ধু জন্মমত বর্ষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-১৪০)।
অর্ধশতাব্দীরপর এসেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আজ সৃজনশীল মানুষের চেতনার, আবেগের এবং পটভূমির এক অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধারে রূপায়িত হয়েছে। তাইতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বত্রই আজ বড় প্রাসঙ্গিক। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতা,ছড়া,গান,উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, চলচ্চিত্র ও মনন সমৃদ্ধ অসংখ্য রচনা।
সাতই মার্চের ভাষণের এক গভীরতম উপলব্ধি থেকেই আমাদের শক্তিধর আধুনিক কবি নির্মলেন্দু গুণের কলম থেকে কর্ষিত হয়েছে অবিস্মরণীয় সেই কবিতা- অংশ বিশেষ……..
“… গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর অমর কবিতা খানি…
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের….”।
বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘সাতই মার্চের বিকাল’(২০১৮) একটি উপন্যাস বটে। কিন্তু এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টির মুহুর্তকে অনুসঙ্গ করে রচিত এই ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসটি থেকেও আমরা একটি সঠিক তথ্য খুঁজে পাই, আর তা হচ্ছে সাতই মার্চের ভাষণ দিতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তুতি ও অবস্থান টা কী ছিল তার আনুপুর্বিক ধারণা। সেই মুহূর্তের বঙ্গবন্ধুর একান্ত আশপাশের অনেকেই আজু বেচে নেই সত্য কিন্তু সেদিন একান্ত পাশে বড়কন্যা শেখ হাসিনা ছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এক বড় উপাদেয় বিষয় হচ্ছে সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ব মুহূর্তের শেখ হাসিনার পর্যবেক্ষণ ও মনোবিশ্লেষণ।তাঁর এই ভাষণ কোন পূর্ব লিখিত ভাষণ নয়। ঐতিহাসিক ভাষণটি আরো দু-চার জন কে নিয়ে লিখে তৈরি করে নেননি। অনেক নেতার সাথে আলাপ করেছেন। কিন্তু বক্তব্যের সারমর্ম নিজের অন্তর থেকেই অনরগল বেরিয়ে এসেছে। উপন্যাসের ভাষা থেকে সেই মূহুর্তের খন্ড-খন্ড কিছু উক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। “—- আব্বা ওপরে উঠলে আমি ভিক্স মালিশ করে দেব। নিচের ঘরে আব্বার সঙ্গে নেতা- কয়টা বাজে দেখ তো? তিনটার সময় তো তাকে রেসকোর্সে যেতে হবে।—- হাসিনা মায়ের কাছে এলে রেনু মেয়েকে বলেন, তোর আব্বার যাওয়ার সময় তো হয়েছেরে? নাকি? হ্যাঁ, আর আধ ঘণ্টা সময় বাকি। আমি তো সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম কত যে কথা হচ্ছে মাগো! চিন্তা করিসনা। তোর আব্বা ঠিকই নিজের মতো করে গুছিয়ে বলবেন। মানুষটা তো রাজনীতির র-ও বোঝে। —- দোতলায় উঠে আসেন বঙ্গবন্ধু। রেনু হেসে বলেন, কথা শেষ হয়েছে? হ্যা, শেষ হয়েছে। সবাইকে রেসকোর্স ময়দানে যেতে বলছি। তাহলে ঘরে চলো। আমিতো জানি ঘরেই যেতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সভায় যাওয়ার আগে তুমি আমাকে একদম একা থাকতে বলো। আজকে জীবন মরণের বিকাল।—- এতক্ষণ নিচতলার ড্রইংরুমে বসে তিনি সবার কথা কুনছেন। যারা কাগজ দিয়েছেন সেসব কাগজ নিয়েছেন। এখন নিজেকে প্রস্তুত করার সময়। দেশ বাসির সামনে কী বলবেন তা নিজের মনে গুছিয়ে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকলে হাসিনার মুখোমুখি হন। কিরে মা? আপনার কপালে-গলায় ভিক্স মালিশ করে দেব আব্বা। হ্যাঁ,দিবি। একটু স্বস্তি হবে। রেনু দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেন, পনেরো মিনিট একদম চোখ বন্ধ করে দিয়ে কুয়ে থাকো।” ( পৃষ্ঠা-৯,১১,১৩,১৪ সাতই মার্চের বিকাল ) উপন্যাস হলেও বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণে যাওয়ার আগমুহূর্তের বর্ণনা থেকেও প্রকৃত সত্যটি বেরিয়ে আসে তার মনের অবস্থাও প্রস্তুতি সম্পর্কে। কারণ এ-সব উক্তি কেবল মাত্র উপন্যাসিকের কল্পনাপ্রসুত নয়। যার জবানিতে লেখক এসব বর্ণনা উপস্থাপন করছেন তিনি কিন্তু সয়ং উপস্থিত নির্ভরযোগ্য এক বাস্তব চরিত্র ও বটে। ইতিহাসের নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যাসন্তান হিসেবে বাঙালি সমাজের চিরাচরিত্র রেওয়াজ মতো তিনি পিতার একান্ত সান্নিধ্যেরই একজন ছিলেন ঐ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর মুহূর্তে। জীবনের অনেক চড়ায়-উৎড়ায় অতিক্রম করে একটা সময় এসে বাবার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য এখন কঠিন হাল ধরেছেন। আর এমনতর একটি সময়ে এসে তার উক্তি দিয়ে রচিত উপন্যাসটি শুধুমাত্র উপন্যাসের ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখা চলে না। শেখ হাসিনার একান্ত পর্যবেক্ষণ শক্তির মধ্যদিয়ে মূলতই ঐতিহাসিক ব্যাক্তিটির চরিত্রের অনেক অজানা তথ্য ও সন্নিবেশিত হলো উপন্যাসটিতে। সুতরাং এ-থেকে প্রতিয়মাণ হয় যে, বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ব মুহূর্তের প্রস্তুতি পর্বটি কেমন ছিলো।
মুজিব তার প্রতিটি ভাষণে পরিমিত শব্দ প্রয়োগের মধ্যদিয়ে জোড়ালো এবং আকর্ষণীয় বাক্যগঠনে কৌশলী ছিলেন। এবং একজন যথার্থ বাগ্মী বলতে তাঁকেই বুঝে থাকি।একজন কর্মী ক্রমে ক্রমে প্রকৃত নেতা হয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিদ্যমান গুণের মধ্যে এই বিশেষ বাগ্মীতা ও উল্লেখযোগ্য একটি বটে। যেটি আমাদের বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সাতই মার্চের ভাষণ তো বটেই, তার অপরাপর ভাষণগুলো যেমন- স্বদেশ প্রত্যাবর্তনোত্তর ভাষণ ( ১০ জানুয়ারি,১৯৭২, রেসকোর্স মাঠ, ঢাকা,) প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ ( ২৬ মার্চ ১৯৭২, ঢাকা,) সমবায়ের উপর ভাষণ ( ৫ এপ্রিল ১৯৭২, বাংলাদেশ বেতার ), জুলিত্ত কুরি শান্তি পদক পেয়ে ভাষণ (২০ নভেম্বর ১৯৭২), বুদ্ধিজীবীদের সভায় ভাষণ ( ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২, চট্টগ্রাম,) প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন ভাষণ ( ১৪ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৪,ঢাকা,) কমিউনিস্ট পাটির দ্বিতীয় কংগ্রেস ভাষণ( ৪ ডিসেম্বর ১৯৭৪, ঢাকা,) ইত্যাকার ভাষণসমূহ গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রতিয়মান হবে তাঁর বাগ্মী, শব্দ গঠন, বাক্য শৈলী কতটা শিল্পোত্তীর্ণ এবং কালোত্তীর্ণ। এ-সব গুণাবলীর কারণেই তাঁর উল্লেখযোগ্য জনসভাগুলোতে লাখো জনতার পিনপতন নীরবতা পরিলক্ষিত হতো। তাঁর এই কালজয়ী ভাষণ গুলো আমাদের বর্তমান প্রজন্মের পুনঃ পুনঃ পাঠকরা ও শুনা প্রয়োজন।
আমরা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ভাষণ গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাবো- আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, স্বামী বিবেকানন্দ ইত্যাকার বিশিষ্ট জনের ভাষণগুলো অনেকটা পূর্ব প্রস্তুতকৃত লিখিত ভাষণই বটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণগুলো মোটেও লিখিত কোন বক্তব্য নয়। তিনি ছিলেন যথাস্থানে, যথাসময়ে স্ব-উৎসারিত একজন বাগ্মী।মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা, ভালোবাসা, ক্ষমা, শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সে মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারেনা, বড় মাপের মানুষ তো নয়ই। আর এ-সব মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন বলেই বাঙালির নেতা, জনগণের নেতা দেশের নেতা, সাধারণ মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটিতে পা ফেলে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে লাখো জনতার সামনে আবেগগণ কন্ঠে বলেছিলেনÑ“ বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাবে এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই দেশে এই চিন্তা করেই মরতে পারি।” ( সূত্রঃ ওষ্কার সমগ্রঃ বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি ঐতিহ্য, ২০১৭)। স্বয়নে স্বপনে তিনি প্রতিনিয়তই এই বাংলার মানুষকে সুখী দেখতে ছেয়েছিলেন। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই যেন তিনি জন্মগ্রহনণ করেছেন এবং জীবনও উৎসর্গ করেছেন।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি অস্ত্র ব্যয় কমিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে মানবিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন-শান্তি পদকোর ভাষণে-“শান্তি আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। শান্তি এ জন্য প্রয়োজন , আমাদের দেশ গঠনের কাজে প্রয়োজন। কোন কোন দেশ তাদের আয়ের শতকরা ষাট ভাগ, সত্তর ভাগ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করেন। অস্ত্র দিয়ে যে দেশ জয় করা যায় না তা তাদের বোঝা উচিত। অস্ত্র দিয়ে যে দেশকে অধিকার করা যায় না তা তাদের জানা উচিত।” (জুলিও কুরি শান্তি পদক পেয়ে ভাষণ , ওঙ্কারসমগ্রঃ বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি ঐতিহ্য,২০১৭) ।
দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তার আকুতি ছিল সাড়েসাত কোটি বাঙালিকে নিয়ে ভেঙ্গেপড়া দেশকে গড়ে তোলা এবং তিনি সাবধান বাণী শুনিয়েছেন কতিপয় সুবিধা ভোগিতে। “আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূতি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধস্তমুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফসল ভোগ করবে।” (সূত্রঃ ওঙ্কারসমগ্রঃ বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রæতিলিপি ঐতিহ্য,২০১৭)।
চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের নানা মুখী সমস্যাকে তুলে ধরে তার সমাধানের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ও যে একটা বড় ভূমিকা থাকতে পারে তা ব্যক্ত করেন। সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম সমস্যা ছিল খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রে বহুমুখী সমস্যার মধ্যে অন্যতম এই তিনটি সমস্যাকে প্রথমে মোকাবেলা করাই ছিল তখন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম চেলেঞ্জ।আর এই চেলেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে তিনি বুদ্ধিজীবীসভায় বলেন ছাত্র শিক্ষক সবাই মিলে এক সাথে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে কাজ করে দেশকে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। (সূত্রঃ ওঙ্কারসমগ্রঃ ঐতিহ্য,২০১৭) । দেশের প্রতি, দেশের অতিসাধারণ জনগোষ্ঠির প্রতি কতটা মমত্ববোধ থাকলে পরে একজন রাষ্ট্রনায়ক দেশের বুুদ্ধিজীবী , শিক্ষক , ছাত্র, শিল্পী সাহিত্যিকদেরকে শহরের পাকাদালান কোটার ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করার আহবান জানান। বাস্তব এক গভীর বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার ছিল নিরন্তর এক সংগ্রাম।
একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গভীর এক বিশ্বাস থেকে উচ্চারিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরি করে একজন বিশ্ব মাপের নেতায় উপনিত হলেন মাত্র পঞ্চান্ন বছর আয়ুশকালে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের সূচনালগ্ন ১৯৪৯ সালে ডিসেম্বর মাসে কারাবন্দি হলেন। আর মুক্তি পেলেন ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি। তাঁর জেলজীবন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল আর এদিকে দেশের ছাত্র, শিক্ষক , বুদ্ধিজীবী সমাজ মাতৃভাষার অধিকারের জন্য সোচ্চার হতে লাগলো। তখন জেলখানার ক্ষুদ্রপ্রকোষ্ঠে বসে ও মুজিব স্থির থাকতে পারলেন না। তার অস্থিরমন ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলতে লাগলো জেল প্রকোষ্ঠে। চুপিসারে সাক্ষাৎ করলেন ভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সাথে। ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন সহ ঢাকা জেলে বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু অনশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সালের সকাল বেলা বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো। অনশন ধর্মঘটের ব্যাপারে আলোচনা করবে বলে। মূলঘটনা তাদেরকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে তাঁর সকল প্রস্তুতি ও শুরু হয়ে গেছে। ফরিদপুর জেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধু (মহিউদ্দিন সহ) সাধারণ অনশন শুরু করেছে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিনের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন মৃত্যু চিন্তা এসে মনে বাসা বাঁধে। “নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই। একজন কায়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম। যদিও হাত কাঁপে তখনি ছোট ছোট কারে চারটা চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেনুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২০৩)। ইতোমধ্যে পূর্ব বাংলায় ঘটে গেলো ভাষার লড়ায় ২১ ফেব্রæয়ারি। খানিকটা দেরিতে হলেও ফরিদপুর কারাগারে বঙ্গবন্ধুর কাছে ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংবাদ পৌঁছে যায়।পরদির ২২ তারিখ ফরিদপুর ও হরতাল হয়েছে। এদিকে ২৫ তারিখ থেকে অনশনরত বঙ্গবন্ধুর অবস্থা খারাপের দিকে। চিন্তিত হয়ে পরলেন সিভিল সার্জন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- “আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তার কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পর চিটি চারখানা ফরিদপুর আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন। আমি তার কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বার বার আব্বা , মা, ভাই-বোনের চেহেরা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে। রেনুর দশা কি হবে? তার তো কেউ নাই দুনিয়ায়। ছোট ছেলে মেয়ে দুইটির অবস্থা কি হবে? তবে আমার আব্বা ছোট ভাই ওদের ফেলবেনা, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম। হাছিনা, কামালকে একবার দেখতে পারলাম না। বাড়ির কেউ খবর পায় নাই। পেলে নিশ্চয় আসত। ” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-২০৫)।
এ-ভাবে জীবনের প্রান্তবেলায় এসে অবশেষে অবিশ্বাস্যের মতো ২৭ ফেব্রুয়ারি “৫২” খবর এলো তাঁর মুক্তি আসন্ন। কিছু দিন বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার পর মুজিব আবার রাজনীতির মাঠে নেমে পড়লেন।ঘরে বসে সময় কাঠানোর জন্য তার জন্ম হয়নি। অনেক নেতাকর্মী-ছাত্র জেলে পড়ে আছে। তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্স করলেন। তাতে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, বাঙালিদের মুক্তি দিতে হবে, যারা ২১ ফেব্রæয়ারিতে শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং যারা অন্যায় ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলেন। এভাবে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিসত্তার স্বপ্ন নিয়ে সামনের এক পংকিল পথ চলতে থাকলেন। (সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী )।
দুই বাংলার বহুমাত্রিক লেখক, বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী, বিশিষ্ঠ্য সমাজচিন্তক অন্নদা শঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২)। দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত আঠারো বছরের চাকুরি জীবনে তিনি পূর্ব বাংলায় কাটিয়েছেন প্রায় ১০ বছর। তৎমধ্যে ১৯৩৩ সালে ও ১৯৩৭ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রামে। তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর একান্তে গিয়ে অনেক অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কথোপকথনের মধ্যদিয়ে বের করে নিয়েছেন যা পরবর্তী বাঙালি জীবনের জন্য এক ঐতিহাসিক দলিল রূপে বিবেচিত। এই অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকারের কথাগুলো তিনি আনুপূর্বিক ভাবে না হলেও, ভাষাও ভঙ্গি বঙ্গবন্ধুর মতো না হলেও বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটিকেই ধারণ করে রেখেছেন ‘ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে’ শিরোনামে। সে থেকে আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা, জয় বাংলার ইতিহাসও। “-হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যায় ভাষাআন্দোলনে। ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশ ভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাস করি, আমার দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাকবাংলা, কেউ বলে পূর্ববাংলা, আমি বলি না, বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা।……জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলাভাষা, বাংলাদেশে ও বাঙালি জাতির জয়। যা সাম্প্রদায়িক ভাবে ঊর্ধ্বে।” (প্রবন্ধঃ ইন্দ্রপাত-অন্নদাশন্কর রায়, কালিও কলম, বঙ্গবন্ধুর জন্মমত বর্ষ সংখ্যা ২০২০,পৃষ্ঠা-১৯৫) চিন্তা-চেতনায়, ভাষায়-বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর মস্তিÍষ্ক যে আশ পাশের অপারাপর নেতৃবৃন্ধ থেকে কতটা উর্বর, কতটা শানিত, কতটা দূরদর্শী, কতটা সহিষ্ণু ছিল তা সহজেই প্রতিয়মাণ হয় এসব ঘটনার আলেখ্যে।
বাংলাদেশকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা ‘কুভোদয়’। এই গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধের সময় কাল ১৯৭১ থেকে ১৯৭২। স্বাধীনতা প্রস্তুতিকাল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং অব্যবহিত পরের দিন গুলো নিয়ে। সুতরাং এই প্রবন্ধ গুলোর গুরুত্ব ও বিশ্লেষণ আমাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বঠে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অন্নদাশঙ্করের অনেক মূল্যবান মন্তব্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি ও ফলাফল নিয়ে একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক মনে করি-
“লড়াই মাত্রই দমের খেলা। যার দম যত বেশি তার জয়ের সম্ভাবনা তত বেশী। আমার বিশ্বাস শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন মানুষ যিনি উভয় অর্থেই অদম্য। তাঁকে দমন ও করতে পারা যাবে না, তাঁর দম ও ফুরিয়ে যাবেনা। এলড়াই যদি তিনি দু’বছর চালিয়ে যেতে পারেন তা হলে সন্ধি হবে তার শর্তেই। ইয়াহিয়া খান, কিংবা জুলফিকার আলী ভূট্টার শর্তে নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কমে তিনি রাজি হবেন না।—- এই যুদ্ধের শেষ পরিণতি যেটাই হোক না কেন সেটা বাঙালির পক্ষে গৌরভজনকই হবে” (পৃষ্ঠা-২৪)। দুই বাংলার আমলা, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক অন্নদাশঙ্কর রায়ের যুদ্ধচলাকালীন সময়ের এই চিন্তা ও মন্তব্য পরবর্তীতে যথার্তই প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কর্মের প্রতি, মনোবলের প্রতি, চিন্তার প্রতি তাঁর কতটা আস্তা জমা থাকলে পরে এই যথার্ত মন্তব্যটি করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুকে যথাযত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই এই সমাজ চিন্তকের মন্তব্য ও যথাযত হয়েছে। উল্লেখ্য তার এই শুভোদয় গ্রš’টি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ ঘটে ১৯৭৪ সালে বাংলা একডেমি আয়োজিত একুশে ফেব্রুয়ারি সম্মেলনে আসলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে একই মঞ্চে বসার সুযোগ হয় এবং বইটি নিরবে তাঁর হাতে তুলেদেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘায়ু পাননি। কিন্তু তিনি স্বল্পায়ুতেও একজন সম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন। সম্পূর্ণ মানুষ কিন্তু কেউ জন্মগত ভাবে বর হিসেবে পান না। নিজেকে তিল তিল করে গড়ে নিতে হয়। আমাদের বঙ্গবন্ধুও সেই শৈসব থেকেই একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন। তার পঞ্চান্ন বছর আয়ুশকাল (হন্তারকের হাতে নিহত ) খুববেশী না হলেও এই অল্প সময়েও তিনি হেঁটেছেন অনেকটা পথ, যা খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষেই সম্ভব। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পায়ু অথচ মৃত্যুঞ্জয়ী এদেরকে আমরা বিরল প্রজ ও বলতে পারি।
রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে জেল, জুলুম, নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলনের এক অকুতোভয় নেতা হয়ে কঠিন মনোবল নিয়ে, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয় লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলেছেন বলেই হয়তো বিশ্বের আরএক বিপ্লবী নেতা কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন-
“I have not seen the Himalayas
but I have seen Sheikh Mujib”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আদ্যোপান্তই একটি শোষণহীন সামাজের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন। আর তাইতো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকে তিনি বলে আসছিলেনঃ-
“বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।”
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ও তিনি এই অঙ্গীকারকে সাথে নিয়ে পথ চলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতক কুচক্রির দল তাঁর সে স্বপ্নকে স্তদ্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষ প্রান্তে (২০২০ সাল) এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তাঁর যুগ্য উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে গড়ে ওঠবে এক শোষণহীন সমাজ। এই সমাজের শোষিত মানুষের এটাই প্রত্যাশা।