বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

5

অ্যাড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী

‘আমি হিমালয় দেখিনি তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমান। আর এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ বিশ্বখ্যাত কিউবার সংগ্রামী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আলিঙ্গন করে এই কথাগুলো বলেছিলেন- বাঙালি জাতির জীবনে যে অল্প কয়েকজন মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর উদার আহবানে একদিন জেগে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতি। ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত এ বাংলাদেশের তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির প্রতীক, হয়ে উঠেছিলেন সকল প্রেরণার উৎস। গোপালগঞ্জের অজপাড়া গাঁেয়র টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া ছোট্ট এক শিশু। বাঙালির অধিকার ও ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল সেই শিশুটি। কোন ধরনের ভীতি,সংশয়, দ্বিধা যাকে গতিরোধ করতে পারেনি, সেই শিশুটির ছোট বেলায় পিতা লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘খোকা’। পরিবারের সবাই খোকা বলে ডাকত। খোকাটির ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবেনা। তিনি শুধু এ দেশের নন, সারা বিশে^র শ্রেষ্ট ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন। কালক্রমে শিশুটি হয়ে উঠেন বিশ^ নন্দিত নেতা। পাড়া প্রতিবেশীরা কখনও ‘খোকা’ আবার ‘মিয়া ভাই’ কখনও সহপাঠী বন্ধুরা ‘মুজিব ভাই’ বলেও সম্বোধন করে ডাকত। তিনি ছোট বেলায় পাখি ভালবাসতেন। পুকুরে সাতাঁর কাটা, এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দেয়া এগুলো ছিল খোকার নিত্যদিনের কাজ। ছেলেবেলা থেকেই খোকা ছিলেন সাহসী,প্রতিবাদী, গরীব দুঃখী মানুষের প্রতি সহনশীল। ব্যক্তি জীবনে খোকা ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে ও সরল প্রকৃতির। জনগণের মুখে হাসি ফুটানোই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাইতো তিনি দরিদ্র ছাত্রদের বই, পরীক্ষার খরচ ও যুগিয়েছেন। পথচারী শিশুদের জামাও পরিয়েছেন। সেই খোকাটিই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ১০ লাখ জনতার সামনে ঐতিহাসিক ভাষন দেন। তিনি বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর এই ভাষনে পুরো বাঙালি জাতি স্বতৎফূভাবে উদগ্রীব হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পশ্চিমা শাসকের বিরুদ্ধে। তিনি এই ভাষণে জাতিকে মুক্তির স্বপ্ল দেখিয়েছেন। সেই শিশুটি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পেছনে তার অদম্য নেতৃত্ব আর ত্যাগ কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছিল। বাংলার মানুষ, আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি সব জায়গাতেই তিনি অমর হয়ে আছেন। খোকার শিক্ষা জীবন শুরু হয় মাত্র ৭ বছর বয়সে। খোকা ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল ও গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ালেখা করেন। পরবর্তীতে মেট্রিকুলেশান (এসএসসি) পাশ করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিএ ডিগ্রী গ্রহণ করে কলিকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। খোকা আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তাইতো ওই বছর ভারত বিভাগের পর আইন অধ্যায়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। আইনের ছাত্র সেই খোকাটি সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতেন। কিন্তু খোকার আইন পড়া বেশীদিন গড়াতে পারেনি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও উদার মনমানসিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গিয়ে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও সক্রিয় ভুমিকা পালন করায় বিশ^বিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে খোকাকে বহিস্কার করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই জন্য তিনি আইনের পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি। পরবর্তীতে বহু যুগ পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাদের আইন বিভাগে স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর চেয়ার। এই স্বাধীন বাংলার বীজ বপনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছিল সেই খোকাটি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন যা ‘বাঙালির মুক্তির সনদ’ হিসেবে খ্যাত, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবরণ, ১৯৬৯ সালের গণ অভুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান সহ প্রতিটি গনতান্ত্রিক ও স্বাধীকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বাংলার এই খোকাটি। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও খোকার স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অবদান কম ছিলনা। স্বাধীন বাংলার এই খোকা ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে কারাগারে থাকাকালে স্বরচিত আত্নজীবনী মুলক প্রথম গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’ বইটি লেখেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটি ছিল ‘কারাগারের রোজনামচা’। গ্রন্থটিতে ১৯৬৬-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইনের এই ছাত্রটির কারাবাসের নির্মম চিত্র ভেসে উঠে। খোকাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভুষিত করেছিলেন ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের এক বিশাল জনসভায় তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ। ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামকরণটি করেন তাঁর নানা শেখ আবদুল মজিদ। সেই খোকাটি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি আর কেউ নন, টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকাটিই বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকার শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপদগামী সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের। কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময়ে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাঙালি জাতির জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে এই জঘন্য হত্যাকান্ড। দেশে তৈরী হয় রাজনৈতিক শূন্যতা, ব্যাহত হয় গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাঙালি জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণীয় নয়। ১৫ আগস্ট জাতির জীবনে একটি কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে বাঙালি জাতি পালন করে। এ দিবসে কালো পতাকা উত্তোলন ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনিমিত রাখা হয়। বিজয়ের এই মাসে জাতির পিতা সহ শহীদদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা অনুষ্ঠান, স্মরণসভা ও কাঙালি ভোজেরও আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা বঙ্গবন্ধুসহ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়াও সর্বস্তরের জনগণও তাঁদের প্রিয় নেতাসহ ৩০ লক্ষ মা বোন সহ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন বিভিন্ন ভাবে। বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা ও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি তাঁর মহান আদর্শে বাঙালি জাতির জীবনে চির অম্লান হয়ে থাকবেন। এই বিজয়ের মাসে তাঁর স্বপ্লের সোনার বাংলা রুপায়নের মাধ্যমেই তাঁর স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে। বাংলা ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশ শংকর রায় যথার্থই লিখেছিলেন-
‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট