বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর শিক্ষা চিন্তা

10

শামসুদ্দীন শিশির

ছবির মতো সাজানো একটি সুন্দর গ্রাম। গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। গ্রামটি বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে সবুজ শ্যামল গ্রামেই জন্ম গ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রামটি তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ছিল। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুন। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপাল গঞ্জে। গোপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। ১৯৩৬ সালে স্বদেশি আন্দোলনকারী এবং নেতাজী সুভাষ বসুর সমর্থকদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৩৮ এ বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রম মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরের সুবাদে ১৯৩৯ সালে কলকাতায় সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও মুসলিম ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব দেন। ঐ কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। পাকিস্তান আন্দোলন এবং সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। দেশ ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বহিস্কৃত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রথম ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদান এবং একই বছর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ এর ২৩শে জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে নয়াচিনে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে স্বল্পকালীন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভার সদস্য হন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বিতীয় বার ১৯৫৭ সালে চীন সফর করেন। ১৯৫৮ সালে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব-বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে ৬ দফা পেশ করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন। ১৯৬৯-এ ছাত্র জনতা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের টালবাহানা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ দেন। যে ভাষণ বিশ্ব হেরিটেজ হিসেবে ইউনেস্কো সংরক্ষণ করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী সভার শপথ গ্রহণ হয়। মন্ত্রীসভা বঙ্গবন্ধুর পূর্ববর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় অর্জিত হলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে স্বদেশে ফিরে আসেন। হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা, কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বচিত হন। প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি ভাবলেন স্বাধীনতা -উত্তর বাংলাদেশের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় আপামর মেহনতি মানুষের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক আদর্শ বা অর্থনৈতিক মুক্তি কোনো কিছুই যথাযথ ভাবে গড়ে উঠবে না। পূর্ব বাংলার জনগণের আশা- আকাক্সক্ষার প্রতিফলনের কথা চিন্তা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেননি। সে সব কিছু বিবেচনা করে গণমানুষের নেতা এদেশের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পরেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এ- দেশের জনগণের প্রয়োজনের নিরিখে ঢেলে সাজানোর চিন্তা করেছেন। রাজনৈতিক হামলা- মামলার কারণে নিজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে না পারলেও আমৃত্যু শিক্ষা- শিক্ষকের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা বহু ভাবেই প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাকে গণ মানুষের কাছে সহজ ও অবৈতনিক করার উদ্দেশ্যে এক ঘোষণায় প্রায় ৩৬০০০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন।
প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত মানুষের মুক্তির পথ রুদ্ধ, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন দুষ্কর হয়ে পড়বে, রাজনৈতিক দীক্ষা মানুষ পাবে না। এ সকল ইতিবাচক চিন্তাই ১৯৭৪ সালের ‘ কুদরত- ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ এর প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু তাত্তি¡ক শিক্ষার চেয়ে প্রায়োগিক বা হাতে কলমে শিক্ষার প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন। চীন সফরে গিয়ে কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে চীনের গৃহীত পদক্ষেপ গুলোর উপর বেশ জোর দিয়েছেন। তিনি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের সম্মানী ও সামাজিক ভাবে সম্মান প্রদর্শন করার কথাও উল্লেখ করেছেন। সার্বিক ভাবে শিক্ষার সকল স্তরে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরির উপর নজর দিতে সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি দল মত নির্বিশেষে সারা দেশ থেকে যোগ্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কুদরত-ই- খুদা কমিশনেও বৃত্তিমূলক, কারিগরি শিক্ষার প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার লাভ করতো। শিক্ষার প্রসারে তাঁর স্বপ্নকে আমরাই পূরণ করবো। বেকারত্ব থেকে মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই। তাই প্রকৃত গবেষণা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাই তৈরি করবে কোটি কোটি কর্মীর হাত।
লেখক: শিক্ষক প্রশিক্ষক ও শিক্ষা চিন্তক

ন্তা