বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের আগামী

102

এমরান চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু আমাদের অহংকার। আমাদের গৌরব। তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম, জেল-জুলুম, অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করে আমাদের উপহার দিয়েছেন বহুল কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। তিনি আমাদের একটি জাতীয় পতাকা দিয়েছেন- যে পতাকার সবুজের মাঝখানে লালবৃত্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরে জীবন উৎসর্গকারী সোনার ছেলেদের। দিয়েছেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি ভ‚খÐ, যা প্রকৃতির অপূর্ব সুষমায় শোভিত। এখানেই শেষ নয়, দিয়েছেন মন পাগল করা জাতীয় সঙ্গীতÑযার প্রতিটি চরণ (মা তোর মুখের বাণী আমার কাছে লাগে সুধার মতো) সুধাময়। সর্বোপরি তিনি একটি জাতির জন্ম দিয়েছিলেন। সেই জাতি বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতিসত্তার বলয়ে তাকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিলেন, যা বাঙালির কোনোকালে ছিল না। তাই তিনি আমাদের জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তিসংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্র্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।’ বঙ্গবন্ধু কত বড়মাপের মানুষ ছিলেন তা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মন্তব্যে খুব সহজে অনুধাবন করা যায়।
এ দেশের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবিরাম ঘাম ঝরিয়ে চারণের মতো সারাদেশ ঘুরে মানুষকে জাগিয়েছেন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের জেলখানায় বছরের পর বছর বন্দি থেকেও অকুতোভয়ে বীরের মতো নিজের সংকল্পে অটল থেকেছেন। মুক্তির মহামন্ত্রে জাতিকে জাগিয়েছেন এবং স্বাধীনতার পথ ধরে জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বপ্নপূরণের চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যে। কৃতিত্ব একান্তভাবে তাঁরই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাঁকে মহীরুহে পরিণত করেছিল। যার ফলে ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার এবং প্রতিষ্ঠাতা।
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ পৃথিবী বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি শৈশব কৈশোরে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। প্রজাপতির মতো দিন কাটিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের শিশুরা যাতে হেসে খেলে বেড়ে উঠে তিনি তাই চাইতেন। শিশুরা যাতে মুক্ত মনে মুক্তচিন্তায় বেড়ে উঠার সুযোগ ও পরিবেশ পায় সে কথা তিনি সব সময় ভাবতেন।
পৃথিবীর অনেক দেশেই জাতীয় ব্যক্তিত্বের জন্মদিন উৎসবসহকারে পালন করা হয়। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ ও তুরস্কের মহান নেতা কামাল আতার্তুকের জন্মদিন রাষ্ট্র্রীয়ভাবে উদ্যাপন করা হয় এবং তাঁদের জন্মদিনগুলো ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিনে জন্মদিন পালন না করে শিশুদের নিয়ে সময় কাটাতেন। আমাদের দেশে এখন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে একবার বঙ্গবন্ধু গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন, নামানো ছিল গাড়ির কাঁচ। চলতে চলতে গাড়িটি থেমে পড়ল ট্রাফিক সিগন্যাল দেখে। হঠাৎ কোথা থেকে এসে দাঁড়াল এক টোকাই। সে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল, ‘অ্যাই, শেখ সাহেব, কেমন আছেন?’
আচমকা এক টোকাইর কুশল জানতে চাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর বিব্রত হওয়ার কথা! কিন্তু তিনি তা হলেন না। বরং হেসে ভালো আছি বলে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এই হলো শিশুদের বঙ্গবন্ধু।
১৯৭২ সালের এক সকাল। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিনের মতো হাঁটতে বেরিয়েছেন। সঙ্গে ছিল তাঁর বড় ছেলে শেখ কামাল। আচমকা তাঁর চোখে পড়ল একটি ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু স্বস্নেহে তাকে কাছে ডাকলেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেন জানতে চাইলে সে জানাল, তার পা ব্যথা করছে, সে হাঁটতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখলেন, জুতার মধ্যে একটি পেরেকের সূচালো মাথা বেরিয়ে আছেÑযার খোঁচায় তার পা থেকে রক্ত ঝরছে। বঙ্গবন্ধু পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন এবং ছেলেটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে তাঁর দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিলেন।
১৯৭৪ সালে গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে চলছিল শিশুমেলা। শিশুমেলা শেষে সমবেত শিশুরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইল। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দরজা সব সময় খোলাই থাকত। শিশুরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি সবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিয়ে একে একে সব শিশুর নাম জানতে চাইলেন। একটি শিশুর নাম মুজিবুর রহমান বললে বঙ্গবন্ধু আদর করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘পেয়েছি, আমার মিতাকে পেয়েছি।’ এমনই শিশু দরদি ছিলেন তিনি। শিশুরা যাতে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো কাজ করে গেছেন। শিশু কল্যাণের নিমিত্তে মা-দের সম্পৃক্ত করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মা ও শিশু কল্যাণ অধিদপ্তর। শিশুর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় শিশু একাডেমি। তিনিই প্রথম প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার তাগিদ উপলব্ধি করেন। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশের সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্তটি ছিল সাহসী ও যুগান্তকারী। ১৯৭৪ সালের ২২ জুন তিনি জারি করেন শিশু আইন, যা ছিল শিশু অধিকারের রক্ষাকবচ।
রাষ্ট্র্রীয় দায়িত্বের পাশাপাশি শিশুদের সব অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যেত। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও। শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’ আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুর মতো সরল, তাঁর হাসিও ছিল শিশুর মতো। আর তাই সারা পৃথিবীর ভালোবাসা ছিল তাঁর জন্য।
আগামীকাল শুরু হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এই আনন্দঘন মুহূর্তে এদেশের প্রতিটি মানুষ তাঁর প্রতি জানাচ্ছে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকএমরান চৌধুরী