বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা

30

 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মূলমন্ত্র। পাকিস্তানি শোষক শ্রেণি থেকে একটি জাতিকে স্বাধীন করার জন্য শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালিকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে ব্যাপক উৎসাহ ও অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এই ভাষণ। এতে ছিল স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। সে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পরাধীন জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন আবেদনময় ও সুনিপুণ দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে সেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। যা সব বয়সী মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। সবচেয়ে তাৎপর্যময় দিকটি হল, ওই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের সময় তো বটেই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও ভাষণটি বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে প্রাণিত ও উজ্জীবিত করে চলেছে। এ ভাষণ হলো সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বজ্রতুল্য ঘোষণা। সেই ভাষণ যখন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সেটি হয়ে ওঠে সমগ্র দেশ ও জাতির গৌরবের সমাচার।
আমরা জানি, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটি দুই বছর ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করার পর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার-২০১৭’-এ অন্তর্ভুক্ত করে। দেরিতে হলেও ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আর শুধু বাঙালির কাছে নয়। এই ভাষণ পুরো পৃথিবীর কাছেই একটি মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। ইউনেস্কোর ‘দ্য মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রকল্পটি ১৯৯২ সালে চালু হয়। তখন থেকে ইউনেস্কো এই প্রকল্পের মাধ্যমেই বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তা সংরক্ষণও করে আসছে। পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশেরই নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। গর্বিত ইতিহাস আছে। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ, সম্পদের অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৈশ্বিক সম্পদগুলো প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের’ মুল লক্ষ্য এসব সম্পদেকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সংরক্ষণ করা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাদের ডিজিটাল তথ্য ভাÐারে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত আছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে এই ভাষণটি ডাউনলোডও করা যাচ্ছে। ইউনেসকোর স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। এটি আমাদের জন্য একই সঙ্গে গৌরব ও আনন্দের। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা বক্তৃতাগুলো নিয়ে উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি নামে যে বই করেছেন, তাতেও ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উচ্চারণ ছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম আজও শেষ হয়নি। আমাদের অব্যাহতভাবে চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। এবারের ৭ই মার্চ উদ্যাপনে ভিন্ন আমেজ রয়েছ্ েকারণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ ভাষণ আরো মধুময় হবে, সকল মানুষের চিত্তাকর্ষণ করবে। প্রেরণার অনুরণ চলবে কালান্তর। জাতির এই আনন্দক্ষণে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই ভাষণের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মতর্ব্য যে, প্রতিটি জাতির জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, সবকিছুকে ছাপিয়ে যা সেই জাতির আত্মার অবিভাজ্য অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেরকমই একটি ঘটনা, যার তুলনা আমাদের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।