বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন

11

বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ

 

বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৭২ সালের এই দিনে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের নায়ক, মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে। পাকিস্তান সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। ৪ ডিসেম্বর এ বিচার শেষ হয়। ১২টি অভিযোগের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাসহ ছয়টি অভিযোগের দন্ড ছিল মৃত্যু। ১৫ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের একদিন আগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়ার যে পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে যে সেলে রাখা হয়েছিল তার পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছিল। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ৬৭টি দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে ব্রিটেনে পাঠাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে স্বদেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু ভারতে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে ২১ বার তোপধ্বনিসহ ১৫০ জনের গার্ড অব অনার দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা, স্বাগত ও অভিনন্দন জানানো হয়। সেদিন বিকালে রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছালে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায় লাখো জনতা। এদিন বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যান। যেখানে তিনি লাখো উল্লসিত বাঙালির সামনে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় ভাষণ দেন। তিনি যুদ্ধকালীন সবার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহŸান জানান তিনি। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম করেছে। আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম; কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার যেসব ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। প্রায় ৩০ লক্ষ শহিদের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ প্রাণ দেয়নি। তিনি বলেছিলেন, আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও, এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে। দেশের মাটির প্রতি, দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় ভরা বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য বাঙালি হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছিল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের জনসাধারণ, সামরিক বাহিনীকে মোবারকবাদ জানানোর পাশাপাশি রাশিয়া, জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনকারী আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে মোবারকবাদ জানিয়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন গড়ে তোলার শুভ সূচনা করেছিলেন।
তিনি তার ভালোবাসার বাঙালির প্রতি আবদারের সুরে বলেছিলেন, আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। যারা পাকিস্তানিদের দালালি করছে যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার। তাঁর সোনার বাংলায় কোনও অভাবী মানুষ থাকবে না। মানুষের মৌলিক অধিকারের পূর্ণতা থাকবে বলে স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, বিরোধ ও বৈষম্য। এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তিনি চেয়েছিলেন যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করবে। যেখানে ধনী-গরিবের মধ্যে কোনও বৈষম্য কমে আসবে। বিরাজ করবে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি।
তিনি দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলেন, দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি নির্ধারণে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান আইনসভার জন্য নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২ জানুযারি সংসদীয় সরকার কাঠামোর অধীনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধু সেই রাষ্ট্রপতির অধীনেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে স্বাধীন দেশে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভেঙ্গে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা এবং সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক, শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতের ভিত মজবুত করা বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এমন এক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেন এবং বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মনোযোগ দেন ও আন্তÍর্জাতিক সাহায্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। দেশ মুক্ত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। এমন নজির পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। এ ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানও স্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, বিধ্বস্ত দেশের যুদ্ধাক্রান্তÍ নাগরিক এবং ভারতের সীমান্তেÍ আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরনার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে তাদের মধ্যে আস্থা গৃষ্টিসহ আর্থিক, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনরুজ্জীবন করা। স্বাধীন দেশে একটি জাতীয় ও পূর্ণাঙ্গ সরকার কাঠামো গঠনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূণ কাজটি বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার আলোকে দক্ষতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের সরকার পরিচালনার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন, নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ, পূর্বে থেকে বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনরেকত্রীকরণ এসব কিছুর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নিরলস পরিশ্রম করে একটি সুদূরপ্রসারী প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখার গোড়াপত্তন করেছিলেন যার ফল আমরা এখনও ভোগ করছি। প্রশাসনিক কাঠামো সমন্বয়ের পরের কাজটি ছিল জাতীয় সংবিধান প্রণয়ন। শেখ মুজিব উনার অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রদান করেন এবং চারটি মূলনীতি হিসেবে “জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র” ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালের ১ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার পর সংবিধানের বিধিমতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা প্রশাসনিক কর্মকাÐে পূর্ণমাত্রায় গতিবেগ সঞ্চার করে। যুদ্ধবিধ্বন্তÍ এ দেশে যাতে একজন মানুষও না খেয়ে মারা না যায়, সেজন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পর ২২ লক্ষেরও বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করার যে দায়িত্ব বর্তেছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উপর তা দক্ষতার সাথে পালন করা হয়। শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেননি; এ জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেজন্য তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি সরকারি এক ঘোষণায় ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালের ছাত্র বেতন মওকুফ করা হয়। শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে যুগান্তÍকারী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন তা হলোঃ আর্থিক সংকট থাকা সত্তে¡ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যস্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তÍ শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সরকারের আরেকটি যুগান্তÍকারী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বায়ত্তশাসন প্রদান। বঙ্গবন্ধু ঘোড়াশাল সারকারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্পস্থাপন, বন্ধ শিল্পলকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রয়াস গ্রহণ করেন। আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পসহ জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে সহায়তা করার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে এবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রন্ত হয় সেক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু নিরলস পরিশ্রম করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ বিতরণ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে দেশের বড় বড় সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, টেলিফোন ভবন পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেন যা ছিল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়। ১৯৭২ সালে ঢাকায় বড় হাসপাতাল বলতে ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত পঙ্গু হাসপাতাল এবং আরও বেশকিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিডিআর গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের ৬ মার্চ তিনি বিডিআর গঠনের আদেশ জারী করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল পদাতিক বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারী করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ মার্চ তিনি কুমিল্লায় বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমী উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের স্বার্থে সশস্ত্রবাহিনীর সহযোগী আরেকটি নিরাপত্তাবাহিনীর প্রয়োজন থেকে বঙ্গবন্ধু সরকার একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণের কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার দেশের একজন মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে। তাই তিনি ক্ষতিগ্রন্তÍ মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। ইসলাম ধর্মের যথাযথ খেদমতের অভিপ্রায়ে ও ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার লক্ষে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার জন্য এক অধ্যাদেশ জারি করেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে দেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। বঙ্গবন্ধু দুস্থ মহিলাদের কল্যাণের জন্য ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি গঠন করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা অস্ত্র সরকারের কাছে সমর্পণের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারি তারিখ বেঁধে দেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই অস্ত্র সমর্পন করেন। বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্বে অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ গ্রæপ, কমনওয়েলথ, আইএলও ও ডবিøউএইচও’র সদস্য পদ লাভ করে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ১০ মে তারিখে আন্তÍর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থার সদস্যপদ পায় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে তার শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো সময়ে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে ১২১টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ ও ওআইসি এর সদস্যপদসহ ১৪টি আন্তÍর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ও মহত্ত¡র দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন, নতুন করে গড়ে উঠবে এ বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার সাধনা।
আমরা সে রকমই একটি বাংলাদেশ চাই। যেখানে বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না জাতিগত-ধর্মীয় ভেদাভেদ। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি চাই, যেখানে হিংসা, অসততার কোনো জায়গা নেই, দুর্নীতির জায়গা নেই। যে রাজনীতিতে শুধু জনগণের ঐশ্বর্য, স্বপ্ন, জনগণের ভালোলাগার জায়গা আছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। আমরা সবাই এক হলে এই দেশ উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে নিশ্চিত।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছিল বাঙালির ত্যাগ, বাঙালির স্বাধীনতা, বাঙালির বিজয়, বাঙালির স্বপ্ন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। এই এগিয়ে যাওয়ায় উন্মোচিত হয়েছে অমিত সম্ভাবনার দিগন্ত। গত এক দশকে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আইন ও নীতি কাঠামোর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত লাভ করবে। যতদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ টিকে থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এ জাতিকে পথ দেখিয়ে যাবে।
আজকের এই দিনে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীরদের মাতৃভূমির জন্য সম্ভ্রম হারানো আড়াই লাখ মা-বোনদের। স্মরণ করি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিহত হওয়া তার পরিবারের সব সদস্যসহ সকলদের। বিন¤্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতীয় চার নেতাকে এবং একাত্তরের রণাঙ্গনের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর