বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি দর্শন ও প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিত

10

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

বিভিন্ন বিজ্ঞজনের প্রকাশিত লেখা ও গণমাধ্যম সূত্রে দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, চলমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন-বৈশ্বিক উষ্ণতা-প্রকৃতি নিধনের বৈরী প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব প্রায় বিপন্ন-পর্যুদস্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস-বন্যা-খরা-তীব্র তাপদাহে পৃথিবী নামক এই গ্রহের সর্বত্রই নানামুখী অনাকাক্সিক্ষত ভয়াবহ পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিলক্ষিত। জনজীবনের স্বাভাবিক-সাবলীল গতিপ্রবাহে এসব মানবসৃষ্ট দুর্যোগ উন্নত বিশ্বকে অনেকাংশে পরাভূত করলেও; উন্নয়নশীল-অনুন্নত দেশসমূহ দুঃসহ যন্ত্রণাদগ্ধ। ভোগবাদী-বিনোদননির্ভর লুম্পেন পুঁজিবাদি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় লÐভন্ড ঝুঁকি থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও মুক্ত নয়। এমন কোন কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানী-প্রকৃতিপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক নেই যারা অতীতে প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্য-বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে আগামীর জন্য একটি নিরাপদ ধরিত্রীর বিষয়ে নিগূঢ় ভাবিত ছিলেন না। বিশ্বকবি রবীঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, পল্লীকবি জসীম উদ্দিনসহ এদেশের প্রায় প্রত্যেকেরই গদ্য-পদ্য-রচনায় ঋতুর পরিবর্তনের সাথে প্রকৃতি-জীববৈচিত্রে অতুলনীয় বন্দনাগাঁথা বাঙালি জাতির সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে করেছে নান্দনিকতায় অত্যুজ্জ্বল।
রবীঠাকুরের ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতায় ‘দিনের আলো নিবে এল সুয্যি ডোবে ডোবে।/ আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।/ মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।/ মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঠঙ্ ঠঙ্।/ ও পারেতে বিষ্টি এল, ঝাপসা গাছপালা।/ এ পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা।/……. আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা, কোথায় বা সীমানা-/ দেশে দেশে খেলে বেড়ায়, কেউ করে না মানা।/ কত নতুন ফলের বনে বিষ্টি দিয়ে যায়,/ পলে পলে নতুন খেলা কোথায় ভেবে যায়!/ ……মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পড়ে মনে,/ কত দিনের লুকোচুরি কত ঘরের কোণে!/ তারি সঙ্গে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান-/ বিষ্টি পড়ে টাপার টুপুর, নদেয় এল বান \’ উল্লেখিত পংক্তিগুলো প্রকৃতি ভাবনায় প্রণিধানযোগ্য। কবি নজরুলের বৈশাখ-শ্রাবণকে নিয়ে অনবদ্য উচ্চারণ নানাভাবে জাতির প্রাণস্পনন্দকে জাগরুক রেখেছে। চলমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রকৃতি বা পরিবেশ বিধ্বংসী কদাচার-অনুন্নয়নের উন্নয়ন সম্পৃক্ত অপরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাজমান সংকট মোকাবেলায় মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেই দেশ পুনর্গঠনে নিবিড় মনোনিবেশ করেন। বিদেশি এক সাংবাদিকের ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে কী করে গড়ে তুলবেন?’ প্রশ্নের জবাবে সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার আছে সুজলাসফলা শস্য শ্যামলা বাংলার মাটি আর আছে সোনার মানুষ।’ মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার মূল উৎসশক্তি ছিল এ দেশের মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুও গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন এদেশের মাটি, মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। তাই দেশ গঠনে সামগ্রিক উন্নয়নের কর্মকৌশলের পাশাপাশি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বনজ সম্পদ উন্নয়নে নিয়েছিলেন নানামুখী পন্থা। বঙ্গবন্ধু সকল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে সার্বক্ষণিক পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঘোরদৌড় বন্ধ করে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে রেসিং ট্র্যাকের উপর সারিবদ্ধভাবে নারকেল গাছ লাগানোর নির্দেশনা দেন। গাছ লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু এটির নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গাছ লাগান গণভবন ও বঙ্গভবনে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ, সবুজ-নির্মল পরিবেশ নিশ্চিতে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির শুরু করে তিনি সবাইকে বাড়ির আশপাশ, পতিত জমিসহ সর্বস্তরে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন।
বিশ্বকবি রবীঠাকুরের অমর পংক্তি ‘দেশকে ভালোবাসিবার প্রথম লক্ষণ ও প্রথম কর্তব্য পরিষ্কারভাবে জানা। দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না-জানি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।’ এর নির্যাস উপলব্ধিতেই বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপের প্রেমে মজেছিলেন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ ভালোবাসা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে তা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর লেখা এই বইয়ে তিনি একাধিকবার মধুমতি নদীর কথা উল্লেখ করেছেন। বইয়ের ১৭১ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি একটা ফুলের বাগান শুরু করেছিলাম। এখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না। জমাদার সিপাহীদের আমি ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনতাম। আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল।’ একজন সত্যিকারের প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ কারাজীবনেও প্রকৃতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। যার অনন্য নজির পাওয়া যায় ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থেও। বইয়ে ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে ফেললাম। তবুও শেষ করতে পারছি না। আমিও নাছোড়বান্দা। আজ আবার কয়েকজন কয়েদি নিয়ে বাদলা ঘাস ধ্বংসের অভিযান শুরু করলাম। অনেক তুললাম আজ। আমি কিছু সময় আরও কাজ করলাম ফুলের বাগানে।’ বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত পর্যালোচনায় তাঁর প্রকৃতি প্রেমের দৃশ্যমনতা সুস্পষ্ট। পরিবেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা সকলের জন্য অনুকরণীয় হয়ে আছে। তৎকালীন গণভবনের এক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, গণভবনে কোনো জেলা প্রশাসক এলে নানা কথার মধ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁকে প্রচুর গাছ লাগানোর কথা বলতেন।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ কর্মসূচি উদ্বোধনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়া যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এটা হলো বেরিয়ার, এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ পর্যন্ত এরিয়া সমুদ্রে তলিয়া যাবে এবং হাতিয়া ও স›দ্বীপের মত আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার সুন্দরবন যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সমুদ্র যে ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করার কোন উপায় আর নাই।’ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত জলবায়ু পরিবর্তন থেকে দেশকে প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়টি দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তখনই যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ফলশ্রæতিতে তিনি উপকূলীয় এলাকায় সবুজায়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব উপলব্ধিতে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করেন। তিনি উপকূলে বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বেশি করে নারকেল গাছ লাগানোর আহŸান জানান। দেশের সমগ্র জাতীয়-আঞ্চলিক রাস্তার দুইপাশে গাছপালা লাগানোর সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতেই।
প্রকৃতি প্রেমিক বঙ্গবন্ধু সুজলাসুফলা বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের অত্যাধিক গুরুত্বারোপে দেশে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং বিধিমালা জারি করেন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত বহুমাত্রিক কর্মকাÐ এখনও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ধারাবাহিকভাবে পবিত্র সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে সংযোজিত হয় ‘রাষ্ট্র বর্তমান-ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র, জলাভূমি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তাবিধান করিবেন।’ পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ‘ওয়াটার পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিনেন্স ১৯৭৩’ জারি করেন। একই বছর পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম সূচিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজসম্পদের অবৈধ পাচার রোধে বঙ্গবন্ধু ‘চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস ফরেস্ট ট্রানজিট রুলস-১৯৭৩’ জারি করেন। এছাড়াও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-১৯৭৪’ প্রণয়ন করা হয় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম’ উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর। সুন্দরবনের বুক চিরে প্রবাহিত নৌপথ দিয়ে ভারী জাহাজ চলাচলে সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধু নির্দেশে লুপ কাটিং ড্রেজিংয়ের সাহায্যে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার বেতবুনিয়া পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ সংযোগ খাল খনন করে ১৯৭৪ সালে মোংলা ঘষিয়াখালী বাণিজ্যিক নৌপথ চালু করা হয়।
সবুজ বিপ্লব সফল করতে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের আহŸান করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। আপনাদের গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের ওপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলাবে সোনার ফসল খেত ভরে। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে। কৃষককে বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। তা না-হলে বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারব না।’ বর্ষায় আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে বন্যার প্রাদুর্ভাব, চৈত্র মাসের খরা ও বৃষ্টিহীনতার দরুন পানির অভাব ইত্যাদি প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মোকাবেলায় পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণে বঙ্গবন্ধু ইপিওয়াপদার পানি উইং আলাদা করে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী চিন্তায় ১৯৭২ সালেই ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা আদায়ে যৌথ নদী কমিশন গঠিত এবং নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে নদী খননের জন্য ড্রেজিংয়ের চুক্তি সম্পাদিত হয়। নদীমাতৃক আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ হাওড় উন্নয়ন বোর্ড, নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার পরিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বন্যা পূর্বাভাসণ ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, ঘূর্ণিঝড় থেকে জানমাল রক্ষায় ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণ এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠার মতো বহুবিধ কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় যে সামাজিক সচেতনতা-আন্দোলনের শুভ সূচনা রচিত হয়েছিল, তা দৃঢ়ভাবে অব্যাহত রেখেছেন জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সবুজায়নের চাদরে আচ্ছাদিত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজ বিশ্বে অনন্য মর্যাদায় সমাসীন। প্রকৃতি ও পরিবশের ভারসাম্য রক্ষায় জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে বর্তমান সরকার বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ২০১৫ সালে দেশরতœ শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার একদিনে এককোটি গাছ লাগানোর কর্মসূচি পালন করেছে। বিরল, বিপদাপন্ন, বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী প্রজাতি সংরক্ষণ, শিক্ষা-গবেষণা, সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদিতে অসামান্য অবদানের জন্য পরিবশে, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০১০ সাল থেকে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন’ পুরস্কার প্রদান করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী ২৮১টি মিউনিসিপ্যালটিতে ‘ভূমি অধিগ্রহণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ পরিকল্পনা’ শীর্ষক প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ছিল- সড়ক উন্নয়ন, ব্রিজ-কালভার্ট-ড্রেন নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ-পুনর্বাসন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, খাল খনন, পাড় বাঁধানো, পুকুর সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন, বৃক্ষরোপণ। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পৌরসভার অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধা-কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে দারিদ্র হ্রাস এবং অপরিহার্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশগত উন্নয়ন। উক্ত প্রকল্প উপস্থাপনা প্রত্যক্ষকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফসলের জমি যাতে নষ্ট না হয় সেভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি নিতে হবে। শুধু ইট-সুরকির স্থাপনা নির্মাণ নয় বরং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’ উক্ত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা নদীতে অপ্রেযোজনীয় সেতু ও বিশের পাশে সাগরপারের মতো উচুঁ বাঁধ নির্মাণ না করার পরামর্শ এবং আবাদি জমি রক্ষার কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্ত’র ‘উটপাখি’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই, ‘আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?/ কেন মুখ গু’জে আছো তবে মিছে ছলে?/ কোথায় লুকোবে? ধু-ধু মরুভূমি;/ ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।/ আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;/ নির্বাক, নীল নির্মম মহাকাশ।/ …….নব সংসার পাতি গো আবার, চলো/ যে-কোনো নিভৃত কন্টকাবৃত বনে।/ মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,/ খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে,/ …….. আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে আমরা দুজনে সমান অংশীদার;/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে, আমাদের দেনা শোধবার ভার।’ এটি সুস্পষ্ট যে অতীতের পরিশুদ্ধ মানবসমাজ প্রকৃতি-পরিবেশকে যথার্থ অর্থে ধারণ করেছিল। দূর অতীতে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের দায়ভাগ তারা কিছু মিটিয়ে গেলেও চলমান সময়কালে সকল দায়ভাগ আমাদের বহন করতেই হবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কদর্য অনাসৃষ্টির ফলে নিরাপদ-নিরাপত্তাহীন পর্যুদস্ত জীবন-জীবিকার প্রতিবন্ধকতায় সত্যের কাঠিন্যে আমাদের ব্যর্থতাকে অভিযুক্ত করবেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি