বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বাঙালি জাতির কাঙ্খিত স্বাধীনতা

22

রতন কুমার তুরী

১৯৬৯ এর গণআন্দোলন ১৯৭০ এর নির্বাচন এই দু’টি প্রেক্ষাপটের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বুঝে নিয়েছিলো যে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংঘটিত হতে চলেছে তাদের মুক্তির সংগ্রামের জন্য, আর সেই জন্যই তারা বঙ্গবন্ধুকে কড়া নজরদারিতে রাখতে লাগলো। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালে নির্বাচন দেয় এবং সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করলেও তৎকালিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা না দিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা করতে থাকে। এবিষয়ে পাকিস্তানের ভ‚ট্টো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একাধিকবার বৈঠক হলেও ভূট্টো কোনো কথাই রাখেনি, এই বিষয় জনগণকে সরাসরি জানাবার জন্য অবশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ভাষণ দেন যেই ভাষণের পরপরই পশ্চিমারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে নিয়ে যান আর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পূর্ববাংলার নিরীহ মানুষের ওপর চালাতে থাকেন অমানবিক নির্যাতন। খুব সম্ভবতঃ বাঙালির দূরদর্শি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি সহসাই গ্রেফতার হবেন আর তাই তিনি ৭ মার্চ তিনি তার দীর্ঘ ভাষণে বাঙালিদের মুক্তি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি দিকনির্দেশা দিয়েছিলেন পরবর্তিতে এই দিকনির্দেশা অনুযায়ি বাংলার মানুষ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে তার ভাষণটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাঙ্গালির অধিকার, নিপীড়ন সর্বোপরি স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি নির্ভয়ে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা সবকিছু বন্ধ করে দেবে….’। এতেই বোঝা যায় বাঙ্গালির প্রাণপ্রিয় নেতা কত দূরদর্শি ছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…’। এই কথার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। তিনি আরো বলেছেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম… ’।
মূলতঃ এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন তাই বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের পরপরই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী খুববেশি রোশানলের শিকার হয়েছিলেন এমনকি ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে অমানবিক অত্যাচার করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ গভীরভাবে নিরীক্ষা করলে দেখা যায় এই ভাষনটি তিনি তৎক্ষণাৎ দিয়েছিলেন। এই ভাষণ দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হয়নি কারণ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রতিটি ইতিহাসের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন, তিনি ভালো করেই জানতেন বাংলাদেশের তখনকার আন্দোলনের গতিপথ কোন দিকে এগুচ্ছে আর তাই তিনি সেদিন লক্ষলক্ষ মানুষের সামনে হৃদয় থেকে উদ্ভাসিত কথামালাগুলো উচ্চারণের মাধ্যমে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছেন। ওই দিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষলক্ষ মানুষ এসেছিলেন শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনতে এবং বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে।
রেসকোর্স ময়দানে সেদিন আগত প্রত্যেকটি মানুষই ছিলেন পশ্চিমপাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে কারণ তারা এর আগে থেকেই যে পশ্চিমপাকিস্তানীরা পূর্ববাংলার মানুষদের শোষণ করে চলেছেন তা ওয়াকিবহাল ছিল এবং তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচনে জেতার পরও যে তারা ক্ষমতা দিচ্ছেনা তাও তারা জানতো ফলে সেদিন বঙ্গবন্ধু যাই বলছিল সবাই একবাক্যে করতালি ও শ্লোগানের মাধ্যমে সমর্থন করে যাচ্ছিল। আর এই অসংখ্য মানুষের সামনেই বঙ্গবন্ধু সেদিন তার দরাজ গলায় বাংলার মানুষের মুক্তির কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন বাংলার স্বাধীনতার কথা।
পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের পথ ধরেই আমরা অর্জন করেছিলাম আমাদের স্বাধীনতা আর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশকে পশ্চিমপাকিস্তানীদের কাছ থেকে মুক্ত করার যুদ্ধে। মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বেশ ভয় পেয়েছিল এবং এই ভাষণের পর তারা বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করেছিল যা আমরা ২৫ মার্চ প্রত্যক্ষ করি। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি জলজ্যন্ত ঐতিহাসিক দলিল যে দলিলে সামান্যতম মিথ্যাও নেই।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক