বঙ্গবন্ধু’র ‘ইয়াজুজ-মাজুজ’

231

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

নুুর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলম। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, মানিকজোড়। এমন বন্ধুত্ব সচরাচর দেখা যায় না, ষাট বছর পরেও অমলিন তাদের সেই সখ্যতা। দু’জনই চট্টগ্রাম শহরের আদি বাসিন্দা, দু’টি প্রাচীন পরিবারের সন্তান। নুর মোহাম্মদ চৌধুরী বক্সিরহাট ও শাহ বদিউল আলম খাতুনগঞ্জের বাসিন্দা। তবে শাহ বদিউল আলম ফিরিঙ্গীবাজারের বিখ্যাত দোভাষ পরিবারের একজন তরুণীর সঙ্গে প্রেম করে ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং সেই থেকে এখন এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি এয়াকুবনগরের বাসিন্দা। এয়াকুবনগর ফিরিঙ্গীবাজারেই সম্প্রসারিত অঞ্চল। আদি দোভাষ এয়াকুব দোভাষের নামানুসারে জায়গাটির নাম রূপান্তরিত হয়ে নামকরণ হয় এয়াকুব নগর।
নূর মোহাম্মদ চৌধুরী বক্সিরহাটের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হাজী ফজর রহমান সওদাগরের বংশধর। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় কোতোয়ালী থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্য কাজ করতে গিয়ে নূর মোহাম্মদ আওয়ামী লীগার হয়ে যান। সেই থেকে বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি আওয়ামী লীগ করেন। কোনদিন দলবদল করেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেঈমানি করেননি। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হলে নূর মোহাম্মদ চৌধুরী তার প্রধান ও শাহ বদিউল আলম উপ-প্রধান নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রাম শহরে দু’জন শরীয়তুল্লাহ সওদাগর ছিলেন-একজন ঊনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বর্তমান ছিলেন। তিনি সরের জাহাজের ব্যবসায়ী ছিলেন এবং সেজন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। চট্টগ্রামের সকল ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর নাম পাওয়া যায়। পাথরঘাটা বান্ডেল রোডে তাঁর বর্তমান বংশধররা বসবাস করেন। আর একজন শরীয়তুল্লাহ সওদাগর কিছুটা পরবর্তীকালের মানুষ। তিনি বিশ শতকের খাতুনগঞ্জের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসার ধাতুতে গড়া মানুষটি আপাদমস্তক ব্যবসায়ীই ছিলেন। তাঁর জীবনের আর কোন লক্ষ্য ছিলো না। কিন্তু তাঁর সন্তানরা তাঁর মতো ব্যবসায়িক প্রতিভা ও বুদ্ধি নিয়ে জন্মাননি। ফলে বংশধরদের অদূরদর্শিতায় শরীয়তুল্লাহ সওদাগরের আড়ত আগের সেই রমরমা ও ঐশ্বর্য হারিয়ে এক অতীতের ছায়া হয়ে কায়ারূপে বর্তমান আছে। শাহ বদিউল আলম শরীয়তুল্লাহ সওদাগরেরই পুত্র। পিতার ব্যবসা নয়, রাজনীতিই তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ও জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর জীবনকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেন এবং তিনি সেই রাজনীতির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাতে অবগাহন করে প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর দুই মুর্শিদ বঙ্গবন্ধু ও জহুর আহমদ চৌধুরী অনেকদিন হলো গত হয়েছেন, ফলে শাহ বদিউল আলমের আর কোন কাজ রইলো না। অন্য কোন নেতা তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক প্রণোদনা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্থানে কাউকে বসানোর কথা কল্পনাও করতে পারেন না। বছরকয়েক অধুনালুপ্ত নন্দনকাননের বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলে ঘোরাঘুরি করে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে সেই যে ঘরে ঢুকে গেলেন সেখান থেকে আর বের হলেন না।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের বছরখানেক পরে কোন একদিন মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র শাহ বদিউল আলম প্রতিদিনের মতো স্কুলের মাঠে (লালদীঘির ময়দানে) খেলতে গিয়ে দেখেন মাঠে শ পাঁচেক লোকের জটলা, কি ব্যাপার। জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন সেখানে একটি জনসভা হবে। তখন মাঠের উত্তর দিকে মঞ্চ করা হত, সে অনুযায়ী উত্তরে দক্ষিণমুখী মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। বিকেল ৪টার দিকে মিটিং শুরু হলে গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে বেশ দীর্ঘদেহী বক্তা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বক্তৃতা করছেন। তিনি এতো সুন্দর ছিলেন যে, তাঁকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছিলো। তাঁর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত শব্দমালা দক্ষিণের পুলিশ পাহাড়ের গাছপালায় প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে গমগম করছিলো। বক্তার নাম জানতে কৌতূহলী হলেন শাহ বদি, শুনলেন তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর কাছাকাছি গিয়ে মুজিবকে একটু ছুঁয়ে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলেন না। সেই থেকে শাহ বদি মুজিবভক্ত।
এই গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা করেছেন, তাঁর গালি শুনেছেন, বকাঝকা খেয়েছেন আবার আদর-সোহাগও পেয়েছেন, এমন মানুষ আমি খুঁজছিলাম। এমন সময় শাহ বদিউল আলম ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর কথা মনে পড়ে গেল।
এ ব্যাপারে তাঁরাই তো উপযুক্ত লোক। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে এখন এমন কেউ নেই, যাঁরা তাঁদের চেয়ে বেশি দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদ্যনির্বাচিত সংসদ সদস্য মোছলেম ভাই আছেন, আনন্দীপুরের প্রবীণ নেতা মুক্তিযোদ্ধা হারিছ দা আছেন, ষাটের দশকের বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা নুরুন্নবী চৌধুরী আছেন, রব্বান ভাই আছেন, রাউজানের কাজী শামসুর রহমান, কাজী আবদুল ওহাব আছেন, চকরিয়ার সালাহউদ্দিন মাহমুদ ও ডা. শামসুদ্দিন আছেন, সত্তরে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাবের আহমদ আজগরী আছেন ও শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন ভাই আছেন; ষাটের দশকের বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা নঈমুদ্দিন চৌধুরী, শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, কলিমউল্লাহ চৌধুরী, রাজা পারফিউমারি-খ্যাত এম এ হাশেম, হাটহাজারীর আবুল হাশেম আছেন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব ভাই আছেন, শ্রমিক নেতা শফর আলী, ষাটের দশকের ছাত্রনেতা এনামুল হক চৌধুরী, ওসমান গণি খান, অমল মিত্র আছেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি তাদেরও থাকার কথা। কিন্তু তাদের স্মৃতির ভাÐার বঙ্গবন্ধুতে পরিপূর্ণ নয়। তাঁরা কেউই নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলমের মত বঙ্গবন্ধুর এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন না।
বদন দীদারি, ইদরিস আলম ছিলেন, কিন্তু তাঁরা এখন প্রয়াত। ফলে সবেধন নীলমণি নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলমই আমাদের ভরসা।
তারা আসলেই বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের, পেয়ারের লোক। সেই তরুণ বয়সে তাঁরা নাড়া বেঁধে বঙ্গবন্ধুর মুরিদ হন। তাঁরা নিজেরাও আজ বৃদ্ধ, আশির কাছাকাছি বয়স। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি তাঁদের জীবনের পরম সম্পদ। একদিন আমি তাঁদের উস্কে দিলাম। তাঁরা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বঙ্গবন্ধুকে তুলে আনলেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন আর হু হু করে কেঁদেছেন। এবার সরাসরি নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদির স্মৃতি থেকে আমি বঙ্গবন্ধুকে যতটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি, তা পাঠকদের জন্য এখানে পেশ করলাম-
চুয়াত্তর সালে দেশ যখন দুর্নীতিতে ছেয়ে যায়, সেই সময় বঙ্গবন্ধু তাঁদেরকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে গিয়ে গোয়েন্দার চাকরি দিয়েছিলেন। সরকারি নয়, বঙ্গবন্ধুর বেসরকারি গোয়েন্দা। বলেছিলেন, তোদেরকে একটা চাকরি দিচ্ছি। কে কোথায় দুর্নীতি, লুটপাট করছে, তাঁর সম্পর্কে লোকে কি বলছে, সেটা জানতে বঙ্গবন্ধু খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তোরা যা জানতে পারবি, তা’ আমাকে জানাস। আর মাস শেষ হলে তোফায়েলের কাছ থেকে বেতন নিয়ে যাবে। এই বলে দু’জনের জন্য একটা বেতন ধার্য করে দিলেন এবং তাঁর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদকেও সে কথা জানিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার রাজনৈতিক সফরে গেছেন। রামুতে তাঁর মিটিং ছিলো, সেটা সেরে কক্সবাজারে ফিরে আসছিলেন। কক্সবাবাজারে যাবার সময় নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিকেও বলে গিয়েছিলেন আমি কক্সবাজার যাচ্ছি, তোরাও আয়। কিন্তু কক্সবাজার গিয়ে কোন কাজকর্ম না পেয়ে দু’জন ফিরে আসছিলেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের যে স্থানে রামুর রাস্তা মিলিত হয়েছে, সেখানে নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিকে পেয়ে যান বঙ্গবন্ধু। গাড়ি থামিয়ে বললেন, তোরা কোথায় যাচ্ছিস্। তারা বললেন আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আমরা চলে যাবো। বঙ্গবন্ধু তখন গাড়িতে তাঁর পাশে বসা বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাককে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মোশতাক, এদেরকে চিনে রাখ্, এরা আমার ইয়াজুজ-মাজুজ। এদের দিকে খেয়াল রাখিস্।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার জন্য ট্রেনে চট্টগ্রাম আসছিলেন। তাঁকে আগ বাড়িয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসার জন্য ফেনী যান নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলম। বঙ্গবন্ধু গ্রীন অ্যারোতে আসছিলেন। ফেনী স্টেশনে ট্রেন থামলে সেখান থেকে খাজা আহমদ উঠলেন। সাড়ে বারটা/ একটার দিকে ট্রেন পৌঁছে বটতলী স্টেশনে। বদি আর নূর মোহাম্মদ স্টেশনে নেমে দেখেন হাজার বারশ’ লোক জমায়েত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রথমে রেস্ট হাউসে যান। কিন্তু সেখানে টেলিফোন না থাকায় পরে শাহজাহান হোটেলে চলে যান। বঙ্গবন্ধু বদি আর নুর মোহাম্মদকে বললেন তোরা মাঠে যা। লোকজন জড়ো হলে আমাকে ফোন করে জানাস। তারা মাঠে গিয়ে দেখেন লালদিঘি লোকারণ্য হয়ে গেছে। মাঠ ভরে মানুষ রাস্তায়ও জমায়েত হয়েছে।
তাঁরা লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে আওয়ামী লীগ নেতা জাকেরুল হক চৌধুরীর মালিকানাধীন আমানিয়া হোটেলে গিয়ে টেলিফোন করে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, অনেক লোক হয়েছে, এবার আপনি আসতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খোন্দকার মুশতাক, তাজউদ্দীন আহমদ ও মিজান চৌধুরী এসেছিলেন। ফেনী থেকে আগত খাজা আহমদও ছিলেন। এবার পুলিশ ক্যান্টিনের দিকে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিলো। বিকেল ৪টা থেকে মিটিং শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করতে ওঠে তাঁর নতুন কর্মসূচি ৬ দফা ব্যাখ্যাসহ শোনালেন। এরপর তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বললেন, রাস্তায় একজন ভিক্ষুক বসে আছে। তাকে কেউ পয়সা দিচ্ছে না। এদিকে তার খিদেও লেগেছে। পাশে একজন খেজুর গুড় বিক্রি করছিলো। ভিখারী ওঠে সেই গুড়ের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তারপর খই-এর মধ্যে ঢুকিয়ে হাত চেটে চেটে খেতে আরম্ভ করলো। এই উদাহরণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ভয় করলে ভয়, হান্ধায় দিলে কিসের ভয়। আমিও ৬ দফা দিলাম। হান্ধায় দিলাম। সভাশেষে জহুর আহমদ চৌধুরী প্রস্তাব আগেই পাঠ করা করে শোনান, যা জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে ইদ্রিস আলম আগেই লিখে রেখেছিলেন।
১৯৭০ এর নির্বাচনের প্রচারণা চালানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার গেছেন। সেখান থেকে ফিরে রাত ৯ টার দিকে জলসার বিপরীতে নিউ মার্কেটের সামনে নামেন। মার্কেট বন্ধ, কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেদিকেই ঢোকার উপক্রম করতে সবাই বলেন, মার্কেট বন্ধ, এখন ঢোকা যাবে না। বঙ্গবন্ধু সেখান থেকে বেরিয়ে একটি খালি গাড়ি দেখে সেটায় উঠে যান। এ সময় বিমাবিদ হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ দৌঁড়ে এসে বললেন, আমার গাড়ি। কে শোনে কার কথা। আলকরণের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি যাচ্ছিলো, তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যাবো? তখন শাহ বদি বলেন, বাহার সিগনাল কাপ্তাই রাস্তার মাথায় বারিক শাহ’র ওখানে যাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শাহ বদিকে জিজ্ঞেস করেন, তোর মা আছে। শাহ বদি বললেন, আছেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, মায়ের সেবা করিস।
বঙ্গবন্ধুর গাড়ি নতুন ফৌজদারহাটে পৌঁছে গেল, রাত তখন দশটা। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নেমে জহুর আহমদ চৌধুরীকে নিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকেন। সেখানে একটি ভাঙা দোকান ছিলো। বঙ্গবন্ধু দোকান থেকে পাঁচটা কোকাকোলার বোতল নিলেন, তাঁর নিজের জন্য একটি, জহুর আহমদ চৌধুরীর জন্য একটি, শাহ বদি ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর জন্য দুটি, আর ড্রাইভারের জন্য একটি। কোকাকোলা নিয়ে দোকানদারকে ১০০ টাকার একটি নোট দেন। দোকানদার বললো তার কাছে ভাঙ্গতি নেই। একটি কোকাকোলা ৭ টাকা করে দাম এসোছিলো ৩৫ টাকা। বঙ্গবন্ধু দোকানদারকে বললেন, বাকি টাকা তুমি রেখে দাও। পরে দোকানদার পরিচয় জানতে পেরে বলেছিলো, ইনিই শেখ মুজিব? ১৯৭০-এ জহুর আহমদ চৌধুরীকে প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দেয়ায় তিনি রাগ করেছিলেন। তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধু ফৌজদারহাট নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর জহুর মিয়া হজে যাচ্ছেন। সেজন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। যাবার সময় শাহ বদিকে বলেন, যাবি? ‘যাবি’ মানে চল্? তাঁর সঙ্গে ঢাকা যেতে হবে কিন্তু সেটা সরাসরি না বলে তাঁর মতামত চাওয়ার ভঙ্গিতে বলা।
জহুর আহমদ চৌধুরীকে বটতলী স্টেশনে বিদায় দিয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান নুর মোহাম্মদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেন, বদি কই?
ওদিকে জহুর মিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তার হজে যাবার কথা বললে তিনি বলেন, দেখ্, নির্বাচন হয়ে গেছে। আমরা জিতেছি। এখনো সংসদ ডাকে নাই। কত প্রয়োজন হতে পারে। ঠিক আছে, তুই যখন যাবার জন্য মনস্থ করেছিস, তখন আমি আর না করবো না, যা। নূর মোহাম্মদ বা বদি সে সময় সেখানে ছিলেন না। জহুর মিয়াই পরে তাদেরকে সে কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু শাহজাহান হোটেলে আছেন। এক রাতে নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর হাতে ২০ টাকা দিয়ে বললেন, বটতলী স্টেশনের উল্টো দিকে নজির শাহ’র মাজারের পাশে একটি দোকান আছে, সেখানে যা এবং আমার জন্য এরিনমোর টোবাকো নিয়ে আয়। পাইপ টানতে পারছি না।
বঙ্গবন্ধু হিমছড়ি গেছেন পাহাড়, ঝর্ণা এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য। তাঁর সঙ্গে বদরুন্নেছা আহমেদের স্বামী প্রধান বন সংরক্ষক নুরুদ্দিন সাহেবও আছেন। সেখানে বেতের চেয়ার বিছানো ছিলো। বঙ্গবন্ধু ও নুরুদ্দিন সাহেব বসার পর একটি চেয়ার খালি ছিলো। সেটি দেখিয়ে চট্টগ্রামের ডিসি এ বি চৌধুরী শাহ বদিকে বলেন, বদি সাহেব, এটাতে আপনি বসেন। শাহ বদি বসলেন। বঙ্গবন্ধু সেটা লক্ষ্য করে বললেন, দেখ্ এই সিটে বসতে আমার ২৩ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর তুই এই বয়সেই বসে গেলি। তোর বয়স কত ?
স্বাধীনতার পর প্রথম চট্টগ্রাম সফরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সার্কিট হাউসে উঠেছেন। হোটেল থেকে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। দু’জনের খাবার জহুর মিয়া ও তাঁর জন্য। শাহ বদি ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের উদ্দেশে বললেন, কিরে খাবি না। তাঁরা বললেন, আমরা খেয়েছি। বঙ্গবন্ধু সেকথা বিশ্বাস করলেন না, তিনি তাদেরকেও খেতে বলেন। খাবারের মেনুতে কই মাছ ছিলো। বঙ্গবন্ধু একটি মাছ তুলে নিয়ে বললেন, কই মাছ খাবি উল্টো দিক থেকে। নইলে কাঁটা ফুটবি।
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে ফরিদপুরে গোয়ালন্দ ঘাটে নামলেন। সেখানে অম্বিকা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভা। বিকেলে সভায় যোগদান করে বঙ্গবন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরী ও অন্য সঙ্গীদের নিয়ে ফরিদপুর রেস্ট হাউসে উঠেন, সেখানে তখন বহু লোক আসছে আর যাচ্ছে। রাতে এক খাটে বঙ্গবন্ধু, আরেক খাটে জহুর মিয়া শয়ন করেছেন। নূর মোহাম্মদ চৌধুরী নীচে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমান। সকালে ঘুম থেকে ওঠে চা-নাস্তা খাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নূর মোহাম্মদ চৌধুরীর হাতে বিশটি টাকা দিয়ে বললেন, তুই চিটাগাং যা, আজিজকে বলবি, চিটাগাং থেকে যত পারে কর্মী পাঠাতে বলবি ঢাকায়। কারণ ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাহাস হবে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর ভুট্টো তাঁকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে বাহাস করবেন এবং ৬ দফাকে অসার প্রতিপন্ন করবেন। বাহাস হবে পল্টন ময়দানে। নূর মোহাম্মদ ১৫ নং পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস হয়ে চট্টগ্রামে এম এ আজিজের কাছে যাওয়ার আগেই জানা গেল ভুট্টো তাঁর চ্যালেঞ্জ প্রত্যাহার করে বাহাস থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
’৭২-এর জানুয়ারির শেষদিকের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে নূর মোহাম্মদ, শাহ বদি, মওলানা নুরুল ইসলাম, ডা. শামসুল আলম ঢাকা যান। ডা. শামসুল আলম বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বন্ধু। ঢাকায় পৌঁছে চট্টগ্রামের উপর্যুক্ত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পুরাতন গণভবনে যান। সেখানে দেখেন মানুষের প্রচÐ ভিড়। তাঁরা ভিতরে ঢুকে দেখেন ক‚টনীতিক ফারুক চৌধুরী, ডিপি ধর, এম আর সিদ্দিকী কথা বলছেন। নূর মোহাম্মদ, শাহ বদি বঙ্গবন্ধুকে সালাম দেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কিরে তোরা বেঁচে আছিস? শাহ বদি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, আপনি কি আমাদের মরে যেতে বলেন। তখন বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, বালাই ষাট, সেকথা কেন বলবো। তোরা শতায়ু হ। পাকিস্তানে বন্দী থাকাকালে সব সময় তোদের কথাই চিন্তা করতাম।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক