বঙ্গবন্ধুর অন্তঃকক্ষ ভাষণের ভাষা

83

সে কারণে দেশের তথা জাতির ভাষাপরিস্থতি অনুধাবনের লক্ষ্যেই প্রয়োজন জাতির পিতার ভাষাজ্ঞানের বিশ্লেষণ; তাঁর ভাষার শৈলী অনুসন্ধান।
বঙ্গবন্ধুর ময়দানের ভাষণগুলো যেমন কাব্যময় তেমনি তাঁর অন্তঃকক্ষ ভাষণগুলোতেও কাব্যগুণ বিদ্যমান। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়: ‘কাব্যং রসাত্মক বাক্যং’। আর ভাষাকে রসসিক্ত করতে দরকার অলঙ্কার। কেননা, অলঙ্কার ভাষার সৌন্দর্য সম্পাদন করে ভাষার রস ধারণের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এমনি এক শব্দালঙ্কার হচ্ছে অনুপ্রাস (ধষষরঃবৎধঃরড়হ)Ñকবিতায় বা প্রবাদ প্রবচনে একাধিক ব্যঞ্জন ধ্বনির পুঃন পুঃন প্রয়োগকে অনুপ্রাস বলে। বঙ্গবন্ধু প্রচুর পরিমাণে অনুপ্রাস প্রয়োগ করেছেন তাঁর ভাষণগুলোতে। এক্ষেত্রে তিনি কেবল অনুরূপ ব্যঞ্জনধ্বনি বা শব্দ নয় বরং কয়েকটি শব্দের একটি বাক্যাংশ পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ করে তাঁর কাব্য নৈপুণ্যের নজির সৃষ্টি করেছেন। যেমন-
ক. ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সে রক্ত যেন বৃথা না যায়। রক্ত দিয়েছে সসামরিক বাহিনীর ভায়েরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে ভ‚তপূর্ব ইপিআর, রক্ত দিয়েছে আনসার, মোহাজেদরা। রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটা বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মদারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে’ (১০ এপ্রিল, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ১৪)।
খ. ‘প্রায় ২০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করে। হত্যা করে বৃদ্ধকে, হত্যা করে মেয়েকে, হত্যা করে যুবককে- যেখানে যাকে পায়, তাকেই হত্যা করে । … এদের পাশবিক অথ্যাচার পশুর মত, বর্বরের মত-যাতে হিটলারও লজ্জা পায়, হালাকু খানও লজ্জা পায়, যাতে চেঙ্গিস খানও লজ্জা পায়,’ (১২ অক্টোবর, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ২৭)।
গ. ‘গৃহহারা, সর্বহারা কৃষক,মজুরী দুঃখী বাঙালি, যারা সারা জীবন পরিশ্রম করেছে, খাবার পায় নাই। তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে বোম্বের বন্দর, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে মাদ্রাজ, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচী, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে ইসলামবাদ, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে লাহোর, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে ডান্ডি গ্রেটবৃটেন। এই বাংলার সম্পদ বাঙালির দুঃখের কারণ ছিল’(০৪ নভেম্বর, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ৩৬)।
ঘ. ‘কিন্তু, আমরা চেয়েছিলাম একটা শোষণমুক্ত সমাজ। আমরা চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। আমরা চেয়েছিলাম এই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। … কাদেরকে হত্যা করা হয়েছে ? হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে, যাঁরা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা। কাদেরকে হত্যা করা হয়েছে ? যাঁরা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল। কাদেরকে হত্যা করা হয়েছে ? পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাঁরা কারা-নির্যাতন, অত্যাচার অবিচার সহ্য করেছে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। … আর, যাদের পয়সায় আমাদের সকলের সংসার চলে, যাদের পয়সায় আমাদের রাষ্ট্র চলে, যাদের পয়সায় আজ আমার এসেম্বলি চলে, যাদের পয়সায় আমরা গাড়ি চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রোল খরচ করি, যাদের পয়সায় আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কী করলাম? সেইটাই বড় জিনিস। … বাংলাদেশকে ভালোবাসব না । বাংলার মাটিকে ভালোবাসব না, বাংলার ভাষাকে ভালোবাসব না, বাংলার কালচারকে ভালোবাসব না। আর ফ্রি স্টাইলে চালাব-এটা হতে পারে না।’ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৭৭-৮৯)।
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিগুলোর নিম্নরেখ বাকাংশের বারংবার ব্যবহারের মধ্যদিয়ে যেমন ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি হয়েছে তেমনি ভাষণের কাব্যময় ভাষার বক্তব্যও গভীর তাৎপর্য লাভ করেছে। আর ভাষণকারকে দিয়েছে এক অনন্য ভাষাশৈলীর গৌরব।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করে জেলে গেছেন। এই ভাষা-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন। হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি নিজেদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। সেই জাতির জন্য একটি দেশ এনে দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁর মাতৃভাষার ঋণের কথা ভুলে যাননি। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা লাভ করে। এর আট দিন পর, ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন মাতৃভাষা বাংলায়। জাতিসংঘে এটি ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এতে করে বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন, আর এই ভাষাভাষী মানুষেরা পেয়েছে গর্ব করার অবকাশ।
বিশ্বপরিসরে এর আগে এমন করে বাংলাভাষাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর অবদানে বিশ্বের দরবারে প্রথম বাংলা ভাষা পরিচিত পেয়েছিল। কিন্তু জানামতে, বিশ্বাঙ্গনের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে চীনের বেইজিং-এ আয়োজিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের শান্তি সম্মেলনে ভারতের মনোজ বসু আর পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন, যা ইংরেজি, চিনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থিত প্রতিনিধিদের শোনানো হয়। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিও তাঁর বক্তব্যটি রেখেছিলেন ইংরেজিতে। ড. মুহম্মদ ইউনুস ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি তাঁর ৩৫ মিনিটের ভাষণের মধ্যে মাত্র দেড় মিনিট বাংলায় বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেতনায় ধারণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছেন সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে। এরপর তিনি যতবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গিয়েছেন, ততবার বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেছেন। অন্তর্জাল থেকে জানা যায়: বিশ্বব্যাপী ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষা বলতে বিশ্ব বাংলাদেশকেই বুঝে। মাতৃভাষা বিবেচনায় বাংলা এখন চতুর্থ। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে সপ্তম। ইউনেসকো ২০১০ সালে বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরেলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানো হয়। বাংলা ভাষার এত গৌরব সত্তে¡ও সারা বিশ্বে তার তেমন কোনো প্রচারের ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। তারচেয়েও বেদনার কথা এদেশের শতাধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগই নেই। অন্যন্য বিষয়ও পড়ানো হয় ইংরেজি মাধ্যমে। ইংরেজি মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বাঙালি জনসাধারণের সেবার চাকুরিতে তাঁরা এখন নিয়োগ পান!
জাতির পিতার মাতৃভাষায় জাতিসংঘে দেয়া ভাষণটিতে চমৎকারভাবে উঠে আসে একাত্তরে বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার সেক্রিফাইস, কোন্ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির এসব ইতিহাস। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি ব্যাখ্যা করে সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বাঙালির মহান নেতা। নাতিদীর্ঘ ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।’ ভাষণে তিনি স্বাধীন বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
একইসঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর সে জন্যই জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পাশে দাঁড়াইয়া আসিতেছে।’
সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাঁর সেই ভাষণে। বাঙালির মহান নেতা বলেন, ‘একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সঙ্কটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। এবং যে বিশ্ব কারিগরিবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।’ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।’ কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে সক্ষম করে তুলবে বলে মত দেন তিনি।
প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’ বাঙালির উদারতার সবটুকু বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বক্তৃতায় তিনি বলেন ‘আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি ভারত ও নেপালের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিবেশিসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশিসুলভ সম্পর্ক বজায় বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলের এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষায় সকল উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’
বাঙালির ক্ষমতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতেন বঙ্গবন্ধু। সে কথা বিশ্ববাসীকে আরও একবার জানিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাঁহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি। কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভর। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা।’ বক্তৃতার শেষ অংশে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’ এমন চমৎকার ভাষায় অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নের কথা জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিরজনক শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ ভাষণেই কথ্যভাষার ব্যবহার বহুল। সমালোচকের ভাষায়: ‘তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি- Poet of Politics। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মধ্যবিত্তের শাহরিক ভাষার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন লোকভাষা। তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় লোকভাষা-আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের বিস্ময়কর সার্থকতা লক্ষ করা যায়।’ সমালোচক এখানে লোকভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাকে হাইফেন দিয়ে ব্যবহার করেছেন। আমাদের কথা বঙ্গবন্ধু ভাষণে লোকভাষা ব্যবহার করেছেন তবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেনি-বড়জোর দুএকটি আঞ্চলিক ক্রিয়াপদের গঠন-সাদৃশ্য আছে বটে। আমরা জানি, লোকভাষা (folk language) কোনো বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা নয়। নাগরিক ভাষার সঙ্গে-বাংলার ক্ষেত্রে মান্য মার্জিত কলকাতার বা শহরের ‘শিষ্ট’ ভাষার সঙ্গে বিরোধে যে ভাষা গ্রাম্য বলে চিহ্নিত হতে পারে তা-ই লোকভাষা। কারো মতে, কথ্য উপভাষার এই অংশের অতীতচারী ঐতিহ্যানুসারিতার মধ্যে কাজ করে নানা ধরনের লোকায়ত প্রবণতা। তাই কথ্য উপভাষার এই অংশের নাম দেওয়া যেতে পারে লোকভাষা। আর আঞ্চলিক ভাষা (regional language) হচ্ছে কথ্য ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। একই ভাষার বিভিন্ন অঞ্চলে কথ্য ভাষার মধ্যে কমবেশি পার্থক্য থাকে এগুলিকেই আঞ্চলিক উপভাষা (regional dialect) বলা হয়। অবশ্য বাংলাদেশে বেশিরভাগ লেখক-গবেষক আঞ্চলিক ভাষা বোঝাতেই উপভাষা (rdialect) ব্যবহার করেছেন। সে-অর্থেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা আঞ্চলিক নয়। বরং তা হতে পারে ব্যক্তিনিষ্ঠ উপভাষা বা নিভাষা (idiolect)।
বাংলার সাধারণ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের ভাষায় কথা বলতে বলতে যখন বঙ্গবন্ধু ময়দানকে মাতিয়ে তোলতেন তখন তাঁর একটা নিজস্ব ভাষাভঙ্গি সৃষ্টি হতো। এমনকি, পাকিস্তান গণপরিষদে কিংবা বাংলাদেশের সংসদেও তিনি চলিত ভাষাতেই তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অথচ, জাতিসংঘের সাধরণপরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি আলংকারিক সাধু ভাষারীতি ব্যবহার করলেন। এই সাধুভাষা সম্পর্কে রূপকথার সুয়োরানী দুয়োরানীর উদাহরণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন: তেমনি বাংলাবাক্যধীপেরও আছে দুই রানী-একটাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা; … সাধু ভাষা ঘষামাজা, সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার-করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা। চলতি ভাষার আটপৌরে সাজ নিজের চরকায় কাটা সুতো দিয়ে বোনা। বিশ্বসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষায় ভাষণ দিলেও ভাষার আটপৌরে সাজ পরিহার করে একটু অলংকারে সাজিয়ে সাধুভাষায় বললেন। এই অলঙ্কার আতিশয্যের কারণেই বঙ্গবন্ধুর সরল বাক্য গঠনের ব্যত্যয় ঘটে। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু জটিল সংগঠনভিত্তিক বাক্য ব্যবহার করেছেন। এর কারণ হতে পারে এখানে আন্তরিকতা থেকে আনুষ্ঠানিকতা বেশি। আবার আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে তো আর আটপৌরে পোশাক পরে যাওয়া হয় না, একটু আলংকারিক জমকালো পোশাক চাই। বঙ্গবন্ধু ভাষা ব্যবহারেও তাই করেছেন। অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বাংলাদেশের সংবিধান, এমনকি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে গৃহীত শোকপ্রস্তাব ও সাধুভাষায় লিখিত-পঠিত হতো। উপরন্তু, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল লিখিত ভাষণ। অনেক সময় লিখিত ভাষণে স্বতঃস্ফ‚র্ততা থেকে কৃত্রিমতা জেঁকে বসে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কিন্তু তা ঘটেনি-ভাষার প্রতি তাঁর স্বতঃস্ফর্ত ভালোবাসার কারণে।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎ কণ্ঠ’। জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ’। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী নেতা তোফায়েল আহমদের ভাষায়: ‘মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহু যুগ ধরে এমন একটি দিনের অপেক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ, ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সফল ধর্মঘট পালন করেছিল। এর পর ’৫২-এর ২১ ফেব্রæয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তিনি কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন (১৮ ফেব্রূয়ারি, ১৯৫২)।
১৯৭০ এর নির্বাচনোত্তর ২১ শে ফেব্রূয়ারি ১৯৭১ খ্রি. কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন: ‘রক্তের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষা করবো, ইনশাল্লাহ্ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে।’ সে রাষ্ট্রভাষার সম্মান বাংলা ভাষাকে কতুটুকু আমরা দিতে পারছি সে প্রশ্নে আজ আর নয়। বাংলা ভাষায় হিন্দি-ইংরেজি শব্দ মিশছে দেখে ভাষা দূষিত হচ্ছে বলে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হই, অন্য দিকে সর্বোচ্চ আদালতে যে বাংলা ব্যবহৃত হয় না সেকথা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ ভাষা যে পরিবর্তনশীল ও নদীর স্রোতের মতে প্রবহমান সেকথা বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও আছে। ১৫ই ফেব্রূয়ারি ১৯৭১ খ্রি. বাংলা একাডেমি আয়োজিত ভাষা-আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না। এই মুক্ত পরিবেশে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অতীত ভূমিকা ভুলে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলা ভাষাকে গণমুখী ভাষা হিসেবে গড়ে তুলেন।’ (ঢাকা : দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ফেব্রূয়ারি, ১৯৭১)। ভাষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি ও স্বচ্ছ ধারণা-ভাবনা পাঠে-তাঁকে একজন ভাষাতাত্ত্বিকের মতোই মনে হয়।
ভাষা-সচেতনতায়ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য। সমাজভাষাবিজ্ঞানীর মতো করেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন কোনো সমাজ-বৈশিষ্ট্যের কারণেই সেই সমাজের ভাষায় বিশেষ বিশেষ শব্দের সৃষ্টি হয়। বাংলায় যেমন bone plate-এর প্রতিশব্দ নেই, মাছে-ভাতে বাঙালির সমাজ-বৈশিষ্ট্যে নেই বলে। তেমনি ইংরেজি cousin-এর বাংলা প্রতিশব্দ অনেক (মামাতো/ খালাতো/ চাচাতো/ ফুফাতো/ মাসতুতো/ পিসতুতো/ জেঠতুতো/ কাকাতো/ তালতো ভাই অথবা বোন) গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার ফলে, যা ইংরেজিতে নেই তাঁদের শহুরে সমাজ-বৈশিষ্ট্যের কারণে। বাঙালির দুর্ভাগ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে তাই বঙ্গবন্ধু বলেন:
‘দুনিয়ার কোন দেশে ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোন অর্থ পাই না বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালি জাতি আমরা পরশ্রীকাতরতা এত বেশি। ইংরেজি ভাষায়, রুশ ভাষায়, ফরাসি ভাষায়, চীনা ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোন শব্দ নাই-একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া’ (৪ নভেম্বর ১৯৭২, গণপরিষদ, ঢাকা, পৃ. ৩৭)।
ভাষণের তথ্য থেকেই জানা যায় বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা ছাড়াও আরও কিছু ভাষার শব্দসম্ভার সম্পর্কে জানতেন। অন্তত বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল বলেই মাতৃভাষার সাথে তুলনামূলক এমন আলোচনায় অগ্রসর হতে পেরেছেন।
ভাষার সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য যেমন ভাষা অধ্যয়নের মাধ্যমে অনুমান করা যায়। তেমনি ইতিহাস অনুসন্ধানে ভাষার অতীত ভিত্তি আবিষ্কার অসম্ভব নয়। আর তাই বলা যায়, ইতিহাস সচেতনতা বা ইতিহাস-ভাবনা এক অর্থে ভাষা সচেতনতা বা ভাষা-ভাবনার নামান্তর। বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন বিশ্ব-ইতিহাসের অংশ তেমনি ইতিহাস নিয়ে তাঁর বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন-
ক. ‘যাঁরা ইতিহাস পড়েন নাই বা শোনেন নাই, তাঁরা জানেন না যে, জার্মানীর লোক এক বছর, দেড় বছর শুধু রুটি খেয়ে ছিল। যাঁরা ইতিহাস পড়েন নাই বা শোনেন নাই, তাঁরা জানেন না যে, রাশিয়ার বিপ্লবের পরে একমাত্র লেলিনগ্রাডে ১২ লক্ষ লোক শীতে মারা গিয়েছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশে স্বাধীনতা আনার পরে দেশের যা অবস্থা হয়, যাঁরা ইতিহাস পড়েন নাই বা শোনেন নাই, তাঁরা জানেন না। যুগোশ্লাভিয়ার কী অবস্থা হয়েছিল, তা তাঁরা জানেন না। ইস্টার্ন কান্ট্রিতুলির কী অবস্থা হয়েছিল, তা তাঁরা জানেন না। বার্মা এবং ইন্দোনেশিয়ার কী অবস্থা হয়েছিল, তা তাঁরা জানেন না’ (১২ অক্টোবর, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ২৯)।
খ. ‘আজ আমাকে স্মরণ করতে হয়, আমাকে অনেক দিনের ইতিহাস আলোচনা করতে হয়। … স্বাধীনতা-সংগ্রাম কেবল নয় মাসই হয় নাই-স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের পর থেকে। … সে সংগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। … আমি মনে করি, সেই দিন, যেদিন জল্লাদ বাহিনী রেসকোর্স-ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্রের মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই তারিখ। সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে। সেই দিনের কথা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। স্পীকার সাহেব, সেই ইতিহাস আমরা রাখতে চাই। … ১৬ই ডিসেম্বর,১৯৭২ তারিখে শাসনতন্ত্র চালু হবে। চালু হবে বাংলার মানুষের নতুন ইতিহাস। … নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করা হোক ঐ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। কারণ, সেই দিন, সেই ৭ই মার্চে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করেছিলাম: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই দিন, সেই ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ (০৪ নভেম্বর, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ৩৫Ñ৫২)।
গ. ‘বাংলার মাটি থেকে যেন এই গোপন হত্যা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, গোপন হত্যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন কোন দিন হতে পারে না। দুনিয়ার ইতিহাসে এরকম কোন নজির নাই’ (০৭ এপ্রিল, ১৯৭৩, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৫৯)।
ঘ. ‘… কোন দেশের ইতিহাসে নাই। পড়ুন দুনিয়ার ইতিহাস, বিপ্লবের পরে যারা বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে, যারা শত্রæদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, কোন দেশ তাদের ক্ষমা করে নাই’ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৮৮)।
বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সচেতনতা ধরা পড়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরের তারিখ নির্ধারণেও। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণেও তিনি ইতিহাস-প্রিয়তার পরিচয় দেন। ইতিহাসকে স্মরণ রাখেন বলেই তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বাংলার ইতিহাসের মহানায়কগণেরে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়:
‘… তাঁদের সেহ ইতিহাস আজ এখানে পর্যালোচনা না করলেও চলবে। কিন্তু বিশেষ কয়েকজন নেতার কথা আজ স্মরণ করছি, যারা গণতন্ত্রের পূজারি ছিলেন; যেমন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, বর্বর পাক বাহিনীর হাতে নিহত ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। আর কলম দ্বারা সংগ্রাম করেছেন সেই জনাব তোফাজ্জল হোসেন-আমাদের মানিক ভাই। স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যঁরা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন’ (১০ এপ্রিল, ১৯৭২, ঢাকা, গণপরিষদ, পৃ. ১৫)।
এই অতীতকে অনুসন্ধান ও লালন মানে স্বজাতির শিকড়কে অনুসন্ধান আর পরিচর্যা। এর মধ্য দিয়েই একজন ব্যক্তি আপন ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করেন। এতে করে তাঁর ভাষাও হয় আপন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। একারণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রচুর বাংলা-ইংরেজি প্রবাদবাক্য ও বাঙালির বহুল প্রচলিত বাগধারার ব্যবহার বিস্তর। যেমন-
ক. ‘কিন্তু শাসনতন্ত্র যাঁরা মানেন না, যাঁরা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, … জাত যায় না ম’লে, খাসলত যায় না ধুলে’ (০৪ নভেম্বর, ১৯৭২, গণপরিষদ, ঢাকা, পৃ. ৫৩)।
খ. ‘কিন্তু তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে’ (২ জুন, ১৯৭৩, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৬৫)।
গ. ‘আজ আমার অবস্থা এই হয়েছে, অল্প শোকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর। … কেউ কিছু বিয়ে যায় না। একদিন সকলকেই মরতে হবে। মৃত্যুটাই স্বাভাবিক’ (০১ জুলাই, ১৯৭৪, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৭৪)।
ঘ. ‘আপনি জানেন, you have a liberty, you have a responsibility একথা ভুললে চলবে না।… Justice delayed, justice denied.. … দুনিয়ায় কোনদিন পাপ আর পূণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। পুণ্য চলে একদিকে, পাপ চলে অন্য দিকে। Vice and virtue cannot go together..’ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৭৯-৮৯)।
ভাষণের ভাষায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহার করে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু সজাগ-সচেতন করতে চেয়েছেন-শিক্ষিত করে গড়ে তোলতে চেয়েছেন। তেইশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রে কোনো শিক্ষানীতিহীন শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে ওঠা যে শিক্ষিত শ্রেণি বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে পেয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা মোটেই ইতিবাচক ছিল না। আর তাই এবিষয়েও তিনি তাঁর চিন্তা-ভাবনা ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন বক্তব্যে:
‘আজ আমরা যারা শিক্ষিত, এম.এ. পাস করেছি, বি.এ. পাস করেছি। স্পীকার সাহেব, আপনি জানেন, এই দুঃখী বাংলার গ্রামের জনসাধারণ আমাদের এই অর্থ দিয়েছে লেখাপড়া শেখার জন্য। আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পাস করেছেন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পাস করেছি-আজ যারা লেখাপড়া শিখছে, তাদের লেখাপড়ার খরচের একটা অংশ দেয় কে? আমার বাপ-দাদা নয়। দেয় বাংলার দুঃখী জনগণ। কী আমি তাদের ফেরত দিয়েছি? তাদের repay করেছি কতটুকু? তাদের প্রতি কতটুকু কর্তব্য পালন করেছি? … আজ আমাদের বিবেচনা করতে হবে, কী আমি দিলাম তাদের? কতটুকু তাদের ফেরত দিয়েছ, যার অর্থে তুমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ, যার অর্থে আমরা আজ বড় বড় গ্রাজুয়েট হয়েছি, যার অর্থে তুমি আজকে ডাক্তার হয়েছ, যার অর্থে তুমি scientist হয়েছ, যার অর্থে তুমি মানুষ হয়েছ, যার অর্থে তুমি প্রফেসর হয়েছ, যার অর্থে তুমি লেখাপড়া শিখেছ? তোমার প্রত্যেকটি শিক্ষার জন্য একটি অংশ বাংলার দুঃখী জনগণ দিয়েছে। … ছাত্রসমাজকে লেখাপড়া শিখতে হবে, লেখাপড়া করে মানুষ হতে হবে, জনগণ টাকা দেয় মানুষ হওয়ার জন্য। … লেখাপড়া শিখে যেন আমরা মানুষ হই। … যদি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমি মানুষ কোথায়?’(২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৮১-৮৭)।
এতো কেবল বক্তৃতা নয়, এ এক গভীর জীবন-দর্শন। দেশের জনগণের টেক্সের টাকায় যে সরকার আমাদের লেখাপড়ার খরচ জোগায় এ বিষয়টিকে বঙ্গবন্ধু চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করেছেন। একই সাথে শিক্ষার উদ্দেশ্য যে মনুষ্যত্ব অর্জন সে কথাও তিান তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, ভাষাদর্শন এমনকি জীবনদর্শনও বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, সে কথাই এ বক্তব্যে ব্যক্ত হয়েছে সহজ-সরল বৈঠকী ঢংএর ভাষায়। একজন রাজনীতিবিদ বা একজন রাষ্ট্রনায়কের শিক্ষা সম্পর্কে এই যে পর্যবেক্ষণ এবং তার এমন স্বচ্ছ ও স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রকাশ-এ সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মাতৃভ‚মি ও মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অমিত ভালোবাসার বদৌলতে। এই ভালোবাসার জোরেই তিনি বলতে পারেন:
‘ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সে জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। … কলে-কারখানায় কাজ করতে হবে। … কাজ করবে না আর পয়সা নেবে-তা হবে না। কার পয়সা নেবে? গরীবের পয়সা নেবে? গরীবের উপর ট্যাক্স বসাব? খাবার আছে তাঁর? কাপড় আছে তাঁর? তার উপর ট্যাক্স বসাব কোত্থেকে? আমি পারব না।’(২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫, জাতীয় সংসদ, পৃ. ৮৬)।
বঙ্গবন্ধু এমন দৃঢ় ভাষায় কথাগুলো বলতে পারতেন তার কারণ ঐ দুঃখী বাঙালির প্রতি তার প্রাণের দরদ। আর তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা-বাণী আজও প্রাসঙ্গিক। বাঙালির দুঃখ দূর করবার সংগ্রামে তাঁর ভাষণ আমাদের প্রেরণা জোগাবে পাথেয় পরিশোধ করবে আরও অনেক দিন।
সেই ভাষণগুলোর আরও বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ পাবার আশায় আমরা শুধু পথ চেয়ে রইনি, প্রাথমিক একটি পথরেখা আঁকবার প্রয়াসে এই সমাজের দিকে তাকাতেই দেখি: একুশের ‘বইমেলা’ কখন যে হয়ে গেল বাংলা একাডেমি ‘গ্রন্থমেলা’ সে খেয়াল নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত দোসরা ফেব্রæয়ারি ২০২০ তারিখে বাংলা একাডেমিতে গ্রন্থমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বইমেলা না গ্রন্থমেলা বলেন ? বইমেলা বলতেই আপন আপন মনে হয় বেশি।’ অথচ আপন শব্দগুলোই আমাদের মাতৃভাষায় আমরা আজকাল ব্যবহার করছি না। এ অবস্থা যেমন ঢাকায় তেমনি কলকাতায়। ওখানেও ‘বইমেলা’কে ‘পুস্তকমেলা’ অভিধা দিয়ে স্বনির্ভর বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুহিতা প্রমাণের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা প্রবহমান। এই গড্ডালিকা প্রবাহে পড়েও আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা বিশ্লেষণ করতে বর্তমান ভাষা পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় সাধনের কথা যেনো ভুলে না যাই। তাত্বিক গবেষণা বা গবেষণা-মডেল ব্যবহার করতে হবে অবশ্যই তবে সে গবেষণার সলিল-ধারা যেন সমকালীন সমাজ-জমিনকে স্নাত করে-অন্তত সিক্ত করে। তবেই বাংলা ভাষাবৃক্ষ এদেশের মৃত্তিকা-রসে সিক্ত-সতেজ হয়ে সগৌরবে বেড়ে উঠবে-আমাদের ছায়া দেবে। সে-ভাষাবৃক্ষের ছায়ায় আমাদের আগামী প্রজন্ম দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পাবে। আর উপলব্ধি করবে মাতৃভ‚মি ও মাতৃভাষায়-‘কী শোভা, কী ছায়া গো’। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে জাতির জনকের উপস্থিতি এক নতুনতর চেতনার দীক্ষা বয়ে আনবে। যে-চেতনার আলোয় দূর হবে বাংলা ভাষা নিয়ে সমকালীন নানান হীনম্মন্যতার তিমির।