বঙ্গবন্ধুকে সঠিক ও হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপন করতে হবে

23

সুপ্রতিম বড়ুয়া

বীর বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে এ মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘপথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি পিতৃ হন্তারকের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও আমাদের প্রতিটি শিরা উপশিরা ও ধমনিতে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এ মাস। ইতিহাসে হয়ত এ মাসে অনেক বিজয়ের কাহিনী লেখা আছে। কিন্তু বিজয়ের সেসব কাহিনী রক্তের স্রোতধারায় মিশেছে আগস্টে এসে। এ মাস নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ মাস প্রতিশোধের চেতনায় শানিত করে সবাইকে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরতে হবে। যদিও সেটি এক প্রকারের অসম্ভব,কিন্তু এটা বুঝতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে সঠিক এবং হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপন করতে না পারি আমাদের ব্যর্থতা থেকে যাবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুঝতে হলে তার গৃহীত নীতিমালা, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতামালা, ও ব্যক্তিজীবন চর্চাকে বুঝতে হবে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে একটা গাইড লাইন পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধুর সকল বক্তৃতামালাকে সুবিন্যস্ত করলে একটি দার্শনিক ভাবধারা বা চিত্রকল্প পাওয়া যায়, যা তার রাজনৈতিক ভাবনা ও আদর্শকে বুঝতে সাহায্য করে। উদহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণে বাংলদেশের রাজনীতির সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন এবং দেশ গঠনে চারটি স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা সম্মিলিতভাবে মুজিববাদ নামে পরিচিতি পায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলার মাটিতে বাঙালি সমাজের উপযোগী সমাজতন্ত্র উদ্ভাবন করতে, আমদানিকৃত সমাজতন্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ ছিল না। পরিতাপের বিষয় আমরা এখন মুজিববাদ ভুলে গেছি, তার বদলে মুজিব কোট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বর্তমান সময়ে এরকম নেতা পাওয়া দুরূহ যিনি সম্পূর্ণরূপে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করতে পেরেছেন। যার মূল কারণ হতে পারে ‘বঙ্গবন্ধুর চর্চা’ থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি।
শিক্ষা প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগ বোধ করি সবার জানা, সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতে। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বঙ্গবন্ধুকে সঠিক ও হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপনে জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, এই ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে আরো শানিত করা প্রয়োজন। বইমেলায় বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর ২৬টি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে যা নিঃসন্দেহে একটা ভালো উদ্যোগ। জাতির মনন বিনির্মাণে এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখে। এর বিপরীত উদহারণও রয়েছে, যদিও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আলোচনার স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্মচারিদের জন্য সদ্য নির্মিত একটি বহুতল আবাসিক ভবন এর নাম রেখেছেন ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’! তারমানে কি আমরা ধরে নিব এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে সেরা অর্জন যা তারা বঙ্গবন্ধুর নামে উৎসর্গ করেছেন। ধরুন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসলো, তখন তাদের দেখানো হবে লর্ড কার্জন হলে বিজ্ঞান চর্চা হয়, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অ্যাসেম্বলি হয়, আর বঙ্গবন্ধু টাওয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা তাদের পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এর আরো ভালো ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আমরা দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক সম্পদ শিক্ষা ও গবেষণার সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম অঙ্কিত হয়নি! তার মানে কোথায় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার হবে আর কোথায় হবে না, সেটা আমরা গভীর বিবেচনায় আনতে পারি নাই।
দেশে কিংবা দেশের বাহিরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের আরো বেশি যত্নবান হবার সুযোগ আছে। আমরা চাইবো আমাদের সর্বোচ্চ সেরাটুকু দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে, যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একটা দিক নির্দেশনা পায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের নেতাদের কিভাবে বিশ্বসভায় তুলে ধরছেন, সেসব কর্মকান্ড থেকে আমারা কি শিখতে পারি সে কথা আমাদের ভাবতে হবে। জন এফ কেনেডি সেন্টার বা ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারগুলো বাংলাদেশের তরুণদের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড নিয়ে কাজ করছে, এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণরা যেমন আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে, পাশাপাশি সেদেশের নেতাদের সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করছে এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে আমরা কবে ‘বঙ্গবন্ধু সেন্টার’ স্থাপনের মত উদ্যোগ নিতে পারবো? আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের মিশনগুলো নিশ্চয়ই কাজ করছেন। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকভাবে বাংলার মাটিতে দুর্নীতিপরায়ণতা, অন্যের সম্পদ দখল, কালোবাজারি, মজুদদারদের সিন্ডিকেট, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। আর আমরা সেই লড়াইটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, আর সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতি হিসেবে আমরা তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখতে পারবো যখন আমরা মুজিববাদী হতে পারবো। বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে মুজিববাদী হওয়াটা যে সহজ কাজ হবেনা, তা আমরা জানি। প্রসঙ্গত, দিল্লির সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে টেনে আনা যেতে পারে। কংগ্রেস যা করতে পারে নাই, সেটা করে দেখিয়েছেন গান্ধীবাদী নেতা আম আদমি পার্টির কর্ণধার অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার করেছেন এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে নজর দিয়েছেন। কেজরিওয়াল এর বিজয় ভারতবাসীকে যেমন একটা বার্তা দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটা বার্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর সেখানেই আমাদের মুজিববাদী হয়ে উঠবার যথার্থতা নিহিত আছে। প্রত্যেক পিতা যেমন তার সন্তানের কাছে সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয়, তেমনি বাঙালি জাতি হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের শেষ আশ্রয়। সুতারং তাকে আমরা যেভাবে উপস্থাপন করবো, প্রজন্ম সেভাবেই গ্রহণ করতে শিখবে। আমরা যদি মুজিবের ছায়া অনুসরণ করতে না শিখি, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের একদিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। মুজিব শতবর্ষে সত্যিকারের মুজিব চর্চা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। একজন মুজিব কেবলমাত্র বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান নয়, একজন মুজিবের প্রয়োজন কখনো শেষ হবার নয়। আমরা চাই বাংলাদেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুর উপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়া এসে পড়ুক, ছায়া পড়ুক বাংলাদেশের বুকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক