বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসলেই ভালোবাসা হবে দেশকে

285

শুরু হয়েছে শোকের মাস, হৃদয় ভাঙার মাস, নিরন্তর রক্তক্ষরণের মাস আগস্ট। ষোলো কোটি মানুষের শোকের মাস এ আগস্ট। এ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই বেদনার । এ মাসের ১৫ তারিখে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছি আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের রূপকার, জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে -সপরিবারে। মাত্র পঞ্চান্ন বছর (১৯২০- ১৯৭৫) বয়সে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বাংলা ও বাঙালির অকৃত্রিম সুহ্নদ, পরম প্রিয় বন্ধুকে। যাঁর জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বতন্ত্র ভূখন্ডের সৃষ্টি হতো না। আমরা পেতাম না লাল সবুজের এ অনন্য সুন্দর পতাকা। পেতাম না হ্নদয়ছোঁয়া গানের কলি” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি… কী শোভা, কী ছায়াগো,কী স্নেহ কী মায়া গো- কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।” পেতাম না পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় আর আলো জ্বলমল শহর,নগর,গন্জ। বিশ্ববাসী জানত না বাঙালি নামে এক লড়াকু জাতির কথা। যারা অসাধ্যকে সাধন করতে জানে এবং তারা তা করে দেখিয়েছে মাত্র নয় মাসে শুধু অদম্য ইচ্ছায় শক্তিশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে। বাঙালির অসীম সাহস আর জানবাজি রাখা বীরত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে প্রায় তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য।

কিন্তু বড়ো দুঃখের বিষয়, কষ্টের বিষয়, নিরন্তর অন্তর্জালার বিষয় পাকিস্তানের মতো বর্বর দেশ যেখানে বঙ্গবন্ধুকে বার বার ফাঁসিতে ঝুলাবার চেষ্টা করেও তাঁর এতটুকু কেশ স্পর্শ করার সাহস পায়নি,আর আমরা কত বড়ো অকৃতজ্ঞ তাঁরই বুকটাকে ঝাঁজরা করলাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় অকৃতজ্ঞতা, অমানবিকতা আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বীরের মতো যুদ্ধ করে যে জাতি মাত্র নয় মাসেরও কম সময়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে সে জাতির জন্য এত বড়ো বেদনার আর কিছুই হতে পারে না । কতিপয় কুলাঙ্গারের কারণে কিছু মানুষ নামের অমানুষের কারণে আজ আমরা পৃথিবীর মানুষের কাছে যে ধিক্কার পাচ্ছি এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী পারে? তাই এ সব মীরজাফরদের আমাদের চিনে রাখতে হবে। কারা এই মীরজাফর? তারা বাইরের কেউ নয়। তারা এ দেশের মাটিতেই জন্ম নিয়েছে, এ দেশের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে আর এ দেশের খেয়ে পরে ঘাড় মোটা করে দেশের স্থপতিকে রাতের আঁধারে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছে। এ সব গাদ্দারদের মানব না বলে দানব বললেই সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ তারা দানবের চেয়েও অধম। ১৭৫৭ সালে যে মীর জাফরের হাতে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল এরা ছিল তারই উত্তরসুরী। এরা হলেনঃ কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), মেজর (অব) বজলুল হুদা, মেজর (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), আবদুল আজিজ পাশা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, লে কর্নেল (অব) এম রাশেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকচক্রের এ নামগুলো সবাইকে মনে রাখতে হবে। চিনে রাখতে হবে এদের ছেলেমেয়ে,মা বাবা আর আত্মীয়স্বজনদের। কারণ তারা কখনো কোনোকালেই দেশ ও জাতির শুভাকাক্সিক্ষ হতে পারে না। জাতির পিতাকে যে বা যারা হত্যা করতে পারে তারা সবসময় বিষধর সর্পের চেয়েও ভয়ংকর। এরা ক্ষমার অযোগ্য, মানুষ নামের কলংক, এরা পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র থেকে চরম ঘৃণা ছাড়া কিছুই পেতে পারে না।
বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান জাতীয়তাবাদীর নেতার হত্যাকান্ডকে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিবেকবান মানুষ নানাভাবে ধিক্কার জানিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো ধিক্কারটি জানিয়েছিলেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে,তারা যে কোনো জগন্য কাজ করতে পারে।(খ্যাতিমানদের চোখে বঙ্গবন্ধু, মুনতাসির মামুন,বাশিশুএ ৭২০, পৃষ্ঠা-২৮)। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মানবতাবাদী নেতাই সোচ্চার হয়েছিলেন।অসীম দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে আমরা এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও তার পরবর্তী জাতীয় চার নেতার হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা হয়ে পড়েছি অভিভাবকহীন,এতিম। নেতৃত্বশূন্যতার কারণে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পার হলেও আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে আমরা কত বড় ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছি সেদিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝে উঠতে না পারলেও বিশ্ববাসী ঠিকই বুঝেতে পেরেছিলেন।ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক সুকর্ণ’র ভাবশিষ্য সুদোনো বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বলেছিলেন,আমরা ইন্দোনেশিয়ার প্রগতিবাদীরা তাঁর মাঝে আমাদের নেতা সুকর্ণকে খুঁজে পেয়েছিলাম। তোমরা তাঁকে মেরে ফেললে।? ক্ষতি যে কত বড়ো, বাইরের লোকেরা তা যত বেশি বুঝতে পেরেছে,তোমরা বাঙালিরা তা পারোনি। তোমরা আমাদের মতই দুর্ভাগা। আমরাও সুকর্ণকে রাখতে পারিনি,তবে তাঁকে আমরা হত্যা করিনি। সেদিক থেকে আমরা অনেক ভালোই আছি।(ঐ পৃষ্টা-২৮)
উপরের উদ্ধৃতি থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কত বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন। এমন একজন মানুষ দেশেতো বটেই বিদেশের মাটিতেও হাজার বছরেও আর জন্মাবে বলে মনে হয় না। অথচ আমরা বাঙালিরা,বাংলাদেশের মানুষেরা কত বড় অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর, নির্মম। এমন একজন মহান মানুষকে আমরা হত্যা করেছি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। সরিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর বুক থেকে। শুধু তাই নয় নিষ্ঠুর, কুলাঙ্গাররা দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যকেও রেহাই দেয়নি। এমন পৈশাচিকতা যারা ঘটিয়েছেন তাদের ঠাঁই কোনো জগতেই হবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ইতিমধ্যেই তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। যারা বেঁচে আছেন তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি আছেন আমাদের নিঃশ্বাসে, আমাদের প্রশ্বাসে।বাঙালির প্রতিটি পদক্ষেপে। কতিপয় কুলাঙ্গার তাঁর উপর রুষ্ট হলেও এ দেশের নব্বই ভাগ মানুষের অন্তর জুড়ে আছে এ মহান জাতীয়তাবাদী নেতা। বাইগার পাড়ের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে উঠা বঙ্গবন্ধুর শৈশবের কটা বছর বাদ দিলে তাঁর পুরোটা জীবন ছিল এ দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত, উৎসর্গিত। পরোপকার, অসম সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, ন্যায়ের পক্ষে অবিচল, আজন্ম আপোশহীন এ সব বিরল মানবীয় গুণাবলির সবটাই তাঁর রক্তে একাকার হয়েছিল।ফলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও বাঘের মতো গর্জন করে বলতে পেরেছিলেন, তোমরা কারা, কি চাস এখানে?
আসুন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। যেমন করে সন্তান ভালোবাসে জন্মদাতা বাবাকে,গর্ভধারিণী মাকে। একজন সন্তানের কাছে মা-বাবার চেয়ে প্রিয়, ভালোবাসার মানুষ আর কেউ থাকতে পারে না। ঠিক তেমনি যে দেশের আলো বাতাসে আমরা বেড়ে উঠছি সে দেশকেও আমাদের ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসতে হবে প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় যে মানুষটির অতুল অবদান রয়েছে তাঁকে, তাঁর আদর্শকে। মা,মাটি, দেশ আর দেশের স্হপতির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ছাড়া দেশপ্রেম পূর্ণতা পায় না। আমরা তখনই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হব যখন মনে প্রাণে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসব। আর বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা মানে দেশকে ভালোবাসা।কারণ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন আত্মার।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক