বঙ্গকন্যা ও করোনা জয়ের সংকল্প

44

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

জাতীয় কবি নজরুলের ‘বিশ্বাস ও আশা’ কবিতা নিবিড়ভাবে ধারণ করেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ‘করোনা প্রতিরোধ’ যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সংকল্প দৃঢ়চিত্তে ব্যক্ত করেছেন। কবিতার কয়েকটি পংক্তি নিবন্ধের সূচনায় উপস্থাপন করতে চাই- ‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে/নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্তে সে মরিয়াছে।/শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ঈমান লয়েছে কেড়ে,/পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে।/থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,/যুদ্ধ না ক’রে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিও না।/ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি মিথ্যা ও অহেতুক/নিরাশায় হয় পরাজয় যার তাহার নিত্য দুখ।’ সমসূত্রে ১৯০৭ সালে বিশ্বকবি রবীঠাকুর রচিত কবিতার কয়েকটি পংক্তির ও বন্দনা করতে চাই- ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,/দুঃখ যেন করিতে পারি জয় \/সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে,/সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা/নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।’ গরবিনী বাঙালি জাতির বাঙ্নিষ্ট প্রায়োদ্বীপ কবি নজরুল ও রবীঠাকুর মানব বিধ্বংসী দেশ-মহাদেশ ব্যাপ্ত ব্যাধি বা মহামারি সম্পর্কে সম্যক ধারণাঋদ্ধ ছিলেন বলেই এই অসাধারণ মনন-সৃজিত কবিতায় ধারয়িষ্ণু শক্তিমানতার প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় প্রায় বার হাজার বৎসরের অস্তিত্ব-অভিজ্ঞতায় কেবল গুটিবসন্ত রোগে তিন থেকে পাঁচ কোটি প্রাণ বিনাশের বিষয়টি অনেকেরই অজানা নয়। ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মিসর, গ্রীস ও ইতালিসহ অন্যান্য অঞ্চলে ‘এন্টোনাইন প্লেগে’ মৃতের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ লক্ষ। ৫৪১-৫৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগে’ আক্রান্ত প্রায় আড়াই কোটি ইউরোপবাসী, ১৩৪৬-১৩৫৩ সালে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্লেগ রোগের কারণে ‘কালো মৃত্যু’র শিকারে প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে বিশ কোটি, ১৮৫২-১৮৬০ সালে তৃতীয় কলেরা মহামারির ফলে ভারতবর্ষ, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকার প্রায় দশ লক্ষ (ইংল্যান্ডে ছিল তেইশ হাজার), ষষ্ঠ কলেরা মহামারিতে (১৯১০-১৯১১) মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ায় প্রাণসংহারের সংখ্যা ছিল প্রায় আট লক্ষ।
অধিকন্তু ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লুতে প্রায় পুরো বিশ্বব্যাপি দুই থেকে পাঁচ কোটি, ১৯৫৬ -১৯৫৮ সালে চীনে উদ্ভূত এশিয়ান ফ্লুতে সিঙ্গাপুর, হংকং ও আমেরিকাতে বিশ লক্ষ (শুধু আমেরিকাতে উনসত্তর হাজার আট শত), ১৯৬৮ সালে হংকং ফ্লুতে দশ লক্ষ, ২০০৫-২০১২ সালে এইচআইভি/এইডস এর কারণে বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকায় প্রায় তিন কোটি ষাট লক্ষ মানব সন্তানের প্রাণনিধনের ঘটনা পুরোবিশ্বকে করেছিল সংহিত আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যায়ে চীনের উহান থেকে আকস্মিক ‘করোনাভাইরাস- কোভিড ১৯’ এর প্রাদুর্ভাব নতুন করে বিশ্বকে অনাকাক্সিক্ষত সংকটে প্রকম্পিত করছে। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুবরণের সংখ্যার দ্রæত বৃদ্ধি আমেরিকা, ইউরোপসহ প্রায় সকল দেশই এ রোগে কমবেশি সংক্রমনিত ।
বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। এই ভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রস্তুতি স্বল্প দেরিতে হলেও অধিকতর আশাব্যঞ্জক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ কোভিড-১৯ কে বিশ্ব মহামারি ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইউরোপের দেশসমূহে করোনাভাইরাসের দ্রæতপ্রসার ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপকে এই মহামারির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যাচিত করেছে। ইতালি ও স্পেনে এর বিস্তার পুরো ইউরোপকে বিশ্বের সবচেয়ে আক্রম্য অঞ্চলে পরিণত করেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়েছে এর নতুন উত্থিত কেন্দ্রবৃত্ত। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই প্রাণঘাতি এসব ব্যাধি যেমন গুটিবসন্ত, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া, যক্ষা, টায়ফুজ, হাম, কুষ্ঠরোগ, হলুদজ্বর, ইবোলা ও জিকা ভাইরাস, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সময়ে সভ্যতাকে করেছে অতিশয় অসহায়, বিপন্ন ও বিপর্যস্ত।
কালক্রমে এর পরিত্রাণ ও উপশমে নানা চিকিৎসা উদ্যোগ সফলতার স্বাক্ষরও রেখেছে। সকাতরে মানব সমাজ বিভিন্ন অভিচার ক্রিয়ায় এসব মহামারিকে বশীকরণ করার পন্থাও উদ্ভাবন করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪.৮৯% জনগণের বসবাস দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রতি কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩০৩ জন। জনবহুল ঘন বসতিপূর্ণ আবাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি এবং ফলস্বরূপ নানাবিধ সংকটের মর্মভেদী সংকেত আরোপ করেছে। ইত্যবসরে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থার নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রাণসংহারক নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ; নেপাল ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী, মালদ্বীপ; শ্রীলঙ্কা; ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টার অংশগ্রহণে সার্ক তহবিল গঠন এবং অর্থ ব্যয়ের সমন্বিত প্রপন্নাধিকার এই অঞ্চলকে করোনা প্রতিরোধে জীবান্তক প্রণোদনায় প্রগত করেছে।
জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় প্রত্যুপক্রম উচ্চারণে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করবেন না, শক্ত থাকুন। সচেতন হোন। রেডিও টেলিভিশনসহ অন্য মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ান। মানুষকে বুঝিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথার্থ প্রস্তুতি, গুজব রটনাকারী এবং দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কঠোর হুশিয়ারি, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনাসহ ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সমগ্র দেশে বাধ্যতামূলক ছুটি প্রদান করে দেশবাসীকে স্বগৃহে আবদ্ধ রাখার সৃজনশীল পন্থা অবলম্বন করে করোনা-প্রতিরোধে অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ এবং দ্রুত জয়ী হওয়ার সংকল্প ঘোষণা সমুত্থিত রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রেষণার পরিচায়ক।
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই ধরনের পরিচিন্তন নির্দেশনা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক সচেতন-প্রবলতা বার্ণিক উপাদানে পরিণত হবে। সতর্কতা অবলম্বনে এই বাচনিক ভৈষজ্য জোরালো অনুষঙ্গ হিসেবে অনুবর্তী পরিণদ্ধ। সরকার কর্তৃক গৃহীত কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, দেশীয় ও বৈদেশিক উদ্যোগে পর্যাপ্ত পিপিই ও পরীক্ষণ কিট সংগ্রহ, অভিজ্ঞ সেবা প্রদানকারী, গণস্বাস্থ্য সংস্থাকে কিট তৈরির অনুমোদন, প্রবাসীদের প্রতি প্রশাসনের বিশেষ নজরদারী, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ, বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের সমন্বিত কর্মযজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সুবিধার সম্প্রসারণ অবিমিশ্র সুদূরপ্রসারি বিচক্ষণতাকে সুদৃঢ় করবেই। অপপ্রচার, গুজব ইত্যাদি নষ্টামি/চক্রান্ত পরিহার এবং সঠিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সতর্কতা ও সচেতনতায় প্রবুদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যথাযথ ভূমিকা পালন চলমান মুহ‚র্তে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের নানাবিধ নির্দেশনা ইতিমধ্যেই দেশব্যাপি বিপুল প্রচারিত। এসবের যথোপোযুক্ত পরিচর্যা ও অনুসরণ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে মানবঢাল হিসেবে বিবেচিত হবে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, আমরা পরিপূর্ণভাবে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারি নি। এটিও সত্যি যে, আদিম সমাজে প্রতিদিন সূর্যোদয় ঘটলেও জ্ঞানসূর্যের আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত হওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের নয়। সুদূর অতীতে এইসব মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অকস্মাৎ বিপদ-আপদ, স্রষ্টার আক্রোশ বা মানুষের প্রতি অভিশাপ-পাপের শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। এই ভ্রান্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের আদি জনক হিপোক্র্যোটিস। তিনিই প্রথম বলেছেন, ‘রোগ-শোকের জন্য স্বর্গের দেবতাগণ দায়ী নন। রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয় একান্তই প্রাকৃতিক কারণে।’
চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক রোগের প্রতিশব্দ প্রচলিত হয়েছে প্রাচীন অলৌকিক বিশ্বাস থেকে। ল্যাটিন শব্দ ‘প্লাগা’ থেকে উ™ূ’ত ‘প্লেগ’ রোগকে দেবতার অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘হাইজিন’ শব্দের নামাকরণ হয়েছিল গ্রীকশব্দ ‘হাইজিয়া’ বা ঔষধের দেবতা ‘এসক্লিপিয়াস’ এর কন্যার নামানুসারে। এভাবেই যুগে যুগে সত্য, বিবেক, জ্ঞাননির্ভর না হয়ে অন্ধকারের পূজারীরা ছিল অপ্রকৃতিস্থ বিভ্রন্তিতে বিভোর। সেজন্যই জগতখ্যাত জ্ঞানতাপস হিপোক্র্যোটিসের অমিয় বাণী ছিল, ‘জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিক্ষা দীর্ঘতর। সুযোগ চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করা বিপজ্জনক এবং বিচার বিবেচনা করাও খুব কঠিন কাজ। তবু আমাদের তৈরি থাকতে হবে, সে শুধু আমাদের নিজের সুখের জন্য নয়। অপরের জন্যও।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা; বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের প্রাণস্পন্দন দেশবাসীর প্রাণপ্রিয়; বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা সকল প্রকার প্রগতি, সভ্য, সুন্দর, শুভ ও কল্যাণযুদ্ধে সর্বোত জয়ী হোন- মহান স্রষ্টার কাছে এটুকুই বিনীত প্রার্থনা।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়