বই উৎসব শিশুদের জন্য নববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার

63

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, হিসাব করলে এক দশকের বেশি নয়, সে সময় গ্রামবাংলার মানুষেরা বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই প্রতিবেশির কোন ছেলেমেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে তার খবর নিয়ে রাখতেন এবং অভিভাবকদের বলে রাখতেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়া বইগুলো যেন তাঁদের জন্য রাখা হয়। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে তাদের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাদের বইগুলো নিজেদের আত্মীয় বা বন্ধুদের দিয়ে দিত। অবস্হাপন্ন পরিবার তাদের আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল আত্মীয়দের বিনামূল্যে এই বই দিত, সাধারণত নতুন বই পরের বছর অর্ধেক মূল্যে, তারপরের বছর এক তৃতীয়াংশ মূল্যে বিক্রি হত। এই বইয়ের মূল্য অনেক সময় বইয়ের মানের ওপর নির্ভর করত। যেসব বই যত্নসহকারে পড়া হয়েছে, ভেতরের কোনো পৃষ্ঠার তেমন কোনো ক্ষতি হয় নাই সেগুলো ভালো দামেই বিক্রি হত। গ্রামবাংলায় লাইব্রেরি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কোনো কোনো উপজেলা সদরে কদাচিৎ দু একটা বইয়ের দোকানের দেখা মিলত। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আগ্রহভরে অপেক্ষা করত কখন তাদের বাবা বা অভিভাবক শহর থেকে বই নিয়ে আসেন। যেদিন নতুন বই নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরতেন সেদিন ওই পরিবারে যেন স্বর্গ নামত, আর সে স্বর্গ ছেলে বা মেয়েটির চোখে মুখে বইয়ে দিত খুশির বন্যা। যে খুশি কোটি টাকার বিনিময়ে পাওয়ার মতো নয়। সেই কী অপার খুশির বন্যা।
আগেকার দিনে প্রত্যেক পরিবারে ছেলেমেয়ের সংখ্যা গড়ে ছয় জনের কম ছিল না। তাছাড়া এই বছর পনেরো আগেও গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার ছিল যৌথ পরিবার। ফলে যৌথ পরিবারের সদস্যদের বই বছরের শেষে হাত বদল হত। সে সময় একটি বই কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ ছেলেমেয়ে পড়তে পারত। নতুন বই কেনার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তুতিটিও রাখা হত যাতে যত্নসহকারে বইগুলো সংরক্ষণ করা হয়। ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিয়ে রাখা হত যাতে বই পড়ার পর বন্ধ করে যথাস্হানে গুছিয়ে রাখে। ছেলেমেয়েদের এই অভ্যাস গড়ে তুলতে একটি কথাও বলা হত (বই খোলা রেখে ঘুমালে, সেই বই শয়তানে পড়ে। তাতে করে সে যা পড়েছে তা ভুলে যায়)। ফলে ছোটবেলা থেকে প্রায় ছেলেমেয়েদের বই গোছানো রাখার অভ্যাস গড়ে উঠতো। এই গোছানো অভ্যাস গড়ে ওঠার ফলে আগেকার ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই ক্রয় খাতে আনেক সাশ্রয় হত। অবশ্য এ সুবিধা পাওয়ার জন্য যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো ঘন ঘন পাঠ্যবই পরিবর্তন না করা। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছর বই পাল্টানো হয়। পরিষ্কার করে বললে বলা যায়, কিছু নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য প্রায় প্রতিবছর বই পুস্তক নতুন করো সাজানো হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে সংযোজন বিয়োজন নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। তাই বলে প্রতি বছর বই পাল্টানো, বছরের পর বছর ধরে বহুল পঠিত ও আদৃত বিষয়গুলো বিয়োজন মোটেই কাম্য নয়। এই কাজটি করতে গিয়ে অনেক প্রিয় ছড়াকবিতা, গদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। সংযোজন করা হয়েছে অনেক দুর্বোধ্য কম পাঠকপ্রিয় কবিতা। গ্রামবাংলার নির্সগ, গ্রামীণ মানুষের সুখ দুঃখ আর পাঁজরভাঙার করুণ চিত্রের অকৃত্রিম রূপকার পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের একটি অসম্ভব পাঠকপ্রিয় কবিতা ছিল নবম দশম শ্রেণির পাঠ্য তালিকায়। কবর নামের সেই কবিতাটির নাম তো বটেই অনেক লাইনও মানুষের মুখে মুখে ফিরে। ‘ এখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে/ ত্রিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দু নয়নের জলে/ এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ/ পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেছে বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। এ রকম হৃদয় ছোঁয়া অনেক কবিতা আছে যা বাংলা সাহিত্যে অমর অজর।
আর একদিন পরেই বই উৎসব। সারা দেশে লক্ষ লক্ষ শিশুকিশোরের হাতে এদিন তুলে দেয়া হবে নতুন নতুন বই। নতুন শ্রেণিতে নতুন বই পাওয়ার আনন্দই অন্য রকম। সেই বই যদি বিনামূল্যে পাওয়া যায় তাহলে আনন্দের মাত্রা বেড়ে হয় দ্বিগুণ। হয় সোনায় সোহাগা। তাছাড়া এরমধ্যে রয়েছে সার্বজনীনতা। সব শিশুর সম অধিকার আর সবার মুখে হাসি ফোটাবার অনন্য প্রয়াস। এক সময় গরিব ঘরের সন্তানেরা নতুন বই দূরের কথা, পুরানো বইও ঠিকমতো জোগাড় করতে পারত না। সরকারের এই মহতি উদ্যোগের ফলে ধনী গরিব নির্বিশেষে এক সঙ্গে একই দিনে বই পাওয়ার মধ্যে যে কী অপার আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই দিনটা মুসলমানদের ঈদের দিনের মতো সকল ভেদাভেদ গুছিয়ে দেয়। সবার হাতে নতুন বই মানে সব শিশু সমান, শিশুটি বস্তিতে থাকে না দালানে থাকে সেটি আজ মোটেই বিবেচ্য নয়। নতুন বইয়ের মিষ্টি সুবাসে প্রজাপতির মতো নাচতে থাকে ফুলের মতো পবিত্র সকল শিশু। তাদের আনন্দ দেখে মনে হবে আকাশ থেকে সকল ডানা কাটা পরি নেমে এসেছে এই ধুলিমাখা পৃথিবীতে।
নতুন বই হাতে নিয়ে অপার খুশির বান ডাকার উৎসবটা শুরু হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনে মহাজোট ধস নামানো বিজয় অর্জন করে। এই বিজয়ের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা যে সব যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার মধ্যে বই বিতরণ একটি অনন্য পদক্ষেপ। ২০১০ সালে প্রথম প্রাক প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের এই উৎসব শুরু হয়। সেই থেকে ১ জানুয়ারি পালিত হয়ে আসছে বই উৎসব। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ৪ কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি বই। তারই ধারাবাহিকতায় আগামী বছরের প্রথম দিন তুলে দেয়া হবে নতুন বই।
বিনামূল্যে বই বিতরণের এই মহাযজ্ঞের এক দশক পূর্ণ হয়েছে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি। ছোটখাট ভুলত্রুটি, কোনো কোনো স্কুলে বই পৌঁছাতে দেরি হওয়া কিংবা বই বিতরণে নানা অভিযোগ থাকলেও সরকারের এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। সাধুবাদ জানাতে হয় মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তবে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তাঁর সহৃদয়তা ও বিশেষ উদ্যোগের জন্য বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ তুলে দেওয়ার এই বিশাল সাফল্যলাভ সম্ভব হয়েছে। এই বিশেষ উদ্যোগ তথা ২০১০ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের এই উৎসব বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রশংসিত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে অর্জিত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের পাশাপাশি সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যপুস্তক উপহার দেওয়া, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান ও পাশের হার বৃদ্ধি শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নেরই স্বাক্ষর বহন করে। দেশের শিক্ষাব্যবস্হার আধুনিকায়ন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষা সহায়ক যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নানা কর্মসূচি গ্রহণের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির নিট হার এখন ৯৯ শতাংশ। বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক