ফেসবুকের কাছে কী তথ্য চায় সরকার

47

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ফেসবুকের কাছে ১৯৬টি অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছে। ফেসবুক এরই মধ্যে ৪৪% অ্যাকাউন্টের তথ্য সরবরাহ করেছে বলে তাদের ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কী কারণে এবং ঠিক কী ধরনের তথ্য ফেসবুকের কাছে চেয়েছে? এবং ফেসবুক এর জবাবে সরকারকে কী বলেছে?
সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণত হত্যা, অপহরণ, জঙ্গিবাদের মতো বিভিন্ন অপরাধের তদন্তের জন্য বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্টের তথ্য পেতে ফেসবুকের কাছে আবেদন জানিয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইমের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান জানান, বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা বিশেষ করে যেগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ডিজিটাল নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত সে বিষয়ে তদন্তে ফেসবুকের কাছে তথ্য চেয়েছে।
আলিমুজ্জামান বলেন, অনেক সময় দেশে ফেক নিউজ ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়, হত্যা বা হামলার হুমকি দেয়, ফেক আইডি থেকে অনেক অবৈধ কাজ পরিচালনা করা হয়, আবার সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা কিংবা সাইবার হ্যারাসমেন্ট অথবা ব্ল্যাকমেইলিং- এ ধরনের ঘটনা তদন্তে আমাদের কিছু ফেসবুক আইডির তথ্যের প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মূলত ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সাবস্ক্রাইবার তথ্য অর্থাৎ অভিযুক্তের পরিচয় বা অবস্থান সনাক্ত করা যায় এমন তথ্যগুলো দিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলোর ঠিক কোন কোন তথ্য প্রয়োজন সেগুলো নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয় বলে ফেসবুক গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফেসবুকের ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আসা এসব অনুরোধ আইন এবং পরিষেবার শর্তাবলী অনুসারে তারা বিবেচনা করে থাকে। আইনগত কিছু বাধ্যবাধকতা থাকায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তথ্য দেয়ার বা প্রত্যাখ্যানের আগে প্রতিটি অ্যাকাউন্ট খুব সাবধানে পর্যালোচনা করে।
আলিমুজ্জামান বলেন, ফেসবুক মূলত সঠিকভাবে সব উৎস ও কারণ যাচাই বাছাইয়ের পর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আমাদের গুরুত্বের ভিত্তিতে আগে বা পরে তথ্য সরবরাহ করে থাকে। মূলত তথ্যগুলো চাওয়ার পেছনে যদি কোন শিশুর ক্ষতি, হত্যার হুমকি অর্থাৎ কারো গুরুতর শারীরিক আঘাত বা মৃত্যুর ঝুঁকির বিশ্বাসযোগ্য কারণ পাওয়া যায়, তাহলে ফেসবুক কোন দেরী ছাড়াই জরুরি ভিত্তিতে তথ্য প্রকাশ করে থাকে।
এই জরুরি ভিত্তিতে তথ্য সরবরাহ বা ইমার্জেন্সি ডিসক্লোজারের কিছু নির্দেশিকা রয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে আবেদন মিলে গেলে তারা সাধারণত ৩০ মিনিটের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করে থাকে বলে জানান মিস্টার আলিমুজ্জামান।
ফেসবুকের জরিপে দেখা যায় যে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে অর্থাৎ ছয় মাসে, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোট ১৯৬টি অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১৩০টির তথ্যই চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি অনুরোধের মাধ্যমে।
ফেসবুক মূলত জন নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে কারো বিরুদ্ধে যদি তার ব্যক্তিগত মত প্রকাশের কারণে অভিযোগ আনা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ফেসবুক কোন সাড়া দেয় না বলেও তিনি জানান। অভিযোগ যাই হোক সেসব তথ্য চাওয়ার অনুরোধ ওই দেশের সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমেই আসতে হবে বলে ফেসবুকের গাইডলাইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, তথ্যগুলো এমন হতে হবে যেন সেগুলো সনাক্ত ও পুনরুদ্ধার করা যায়। কেননা, ব্যবহারকারীরা যদি তথ্যটি মুছে ফেলেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা কারো ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের আইডি ট্র্যাকিং বা প্রক্রিয়াকরণের জন্য ফেসবুকের ল’ এনফোর্সমেন্ট অনলাইন রিকোয়েস্টের মাধ্যমে তাদের অনুরোধ জমা দিতে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে কারো অনুরোধ ফেসবুক গ্রহণ করে না। এ কারণে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি সমস্যার মুখোমুখি হন, তাহলে তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তথ্য চাইতে হবে। এছাড়া ফেসবুকের ঠিকানায় সরাসরি লিখিতভাবে অনুরোধ জানানোর সুযোগ রয়েছে। তবে চিঠির মাধ্যমে আসা আবেদনের তথ্য প্রক্রিয়াকরণে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। যোগাযোগের ঠিকানা- টহরঃবফ ঝঃধঃবং সধরষরহম ধফফৎবংং : ১৬০১ ডরষষড়ি জড়ধফ, গবহষড় চধৎশ ঈঅ ৯৪০২৫.
ফেসবুক এসব অনুরোধের প্রতিক্রিয়া জানাতে কিছু অর্থ চার্জ করতে পারে বলে প্রতিষ্ঠানটির ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদনে জানানো হয়। প্রতিটি একাউন্টের অনুরোধের ভিত্তিতে এই অর্থ প্রযোজ্য হয় বলে সংস্থাটি উল্লেখ করে। এছাড়া অস্বাভাবিক বা জটিল অনুরোধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি চার্জ করা হতে পারে বলেও জানায় তারা। তবে সম্ভাব্য ক্ষতির তদন্তের ক্ষেত্রে বা ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় এই ফি কম/বেশি অথবা বিনামূল্যেও হয়ে থাকতে পারে।
ফেসবুক মূলত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসা সরকারি অনুরোধগুলো গ্রহণ করে থাকেন তারপর তারা ওই অ্যাকাউন্টগুলোর তথ্যের স্ন্যাপশট সাময়িক সময়ের জন্য সংরক্ষণ করে থাকেন। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তারা সেই তথ্যগুলো সরবরাহ করে থাকেন। তবে অনেক তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে ফেসবুক ইউজার নিজেই আগে থেকেই অনুমতি দিয়ে থাকে। এরমধ্যে রয়েছে তার ছবি, ভিডিও, টাইমলাইন পোস্ট ইত্যাদি।


আপনার বোনাস-ভাতা
কীভাবে নির্ধারিত হয়?
বিবিসি বাংলা
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি অফিসে যারা চাকরি করেন নিয়মানুযায়ী তাদের সবাই নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসবের আগে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বোনাস বা উৎসব ভাতা পাওয়ার যোগ্য। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী বেতন ভাতা ও বোনাস নির্ধারিত হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শিল্প-কারখানা এমনকি গণমাধ্যমে শ্রম আইনের আওতায় তৈরি করা বিধিমালা অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস দেয়ার বিধান রয়েছে। যদিও কিছু শিল্প কারখানায় বিশেষ করে ঈদের আগে বেতন ও বোনাসের দাবিতে নানা প্রতিবাদের ঘটনাও দেখা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জায়েদী হাসান খান বলছেন, কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসবের প্রাক্কালে প্রদেয় বিধি দ্বারা উৎসব ভাতা পাওয়ার অধিকার আছে। তবে সব ক্ষেত্রেই কোনো প্রতিষ্ঠানে যারা ন্যূনতম এক বছর ধরে কাজ করছেন তারাই এ সুবিধা পাবেন। ধর্মীয় উৎসবে বোনাস দেয়ার বিধান শ্রম আইন ও এর ভিত্তিতে প্রণীত শ্রম বিধিমালায় উল্লেখ করা আছে। তিনি বলেন, কেউ বোনাস বা উৎসব ভাতা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি শ্রম আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, বেতনের মতো বোনাস পাওয়াটাও শ্রমিকের অধিকার। সরকারি বা সরকারি বিধিবদ্ধ দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতই বোনাস দেয়া হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বহু শিল্প কারখানাও নিয়মিত বোনাস দেয় কর্মীদের। কারণ এটি তাদের প্রাপ্য।
তিনি বলেন, এখন নিয়োগ দেয়ার সময়ই অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগপত্রে উল্লেখ করে যে কর্মী কি কি সুবিধা পাবেন এবং সেখানে বছরে দুটি উৎসব ভাতার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করে দেয়া থাকে।
বোনাস বা ভাতা হল কোন কর্মীর জন্য তার নিয়মিত মজুরির অতিরিক্ত বাড়তি পাওনা। কোন প্রতিষ্ঠান কোন উপলক্ষ বা উৎসব পালন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন (যেমন- উৎপাদন), সময়ানুগ উপস্থিতি, নিষ্ঠার সংগে কর্ম সম্পাদন প্রভৃতির জন্য বোনাস দিতে পারে।
জায়েদী হাসান খান বলছেন, সরকারি চাকুরে বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাধারণত চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তাদের সর্বশেষ মূল বেতনের সমান অর্থ বোনাস হিসেবে দেয়া হয়। তবে মনজিল মোরশেদ বলছেন, বোনাস নিয়ে সরকারি বা সরকার নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমস্যা না হলেও বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানে নানা সমস্যা দেখা যায় মাঝে মধ্যেই।
তার মতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের মূল বেতনের সমপরিমাণ দেয়া হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎসব ভাতায় ভিন্নতা রয়েছে। কারণ এটা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অনুযায়ী তারাই নির্ধারণ করেন। কেউ মূল বেতনের সমান, কেউ ৫০ভাগ কিংবা ৭০/৮০ ভাগ দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ শ্রম আইনের আওতায় প্রণীত বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে যারা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এক বছর চাকরি পূর্ণ করেছে তাদের বছরে দুটি উৎসব ভাতা দিতে হবে। তবে এই শর্তও আছে যে প্রতিটি উৎসব ভাতা মাসিক মূল মজুরির অধিক হবে না, এবং তা মজুরির অতিরিক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
যদিও আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, সরকারি কর্মচারীরা এখন কার্যত তিনটি উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। কারণ সরকার এখন তাদের বাংলা নববর্ষে একটি বোনাস দিয়ে থাকে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মীদের বাংলা নববর্ষের বোনাস দিতে শুরু করেছে। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের একাধিক বোনাসের সমপরিমাণ অর্থও দিয়ে থাকে ধর্মীয় উৎসবের আগে।
জায়েদী হাসান খান বলছেন, কোন কর্মী তার উৎসব ভাতা না পেলে তার আইনগত প্রতিকার পাওয়ারও অধিকার আছে। এক্ষেত্রে শ্রম আইনের আওতায় যারা আছেন তারা শ্রম আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন বলে জানান তিনি। যদিও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দেশের যে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করেন তাদের বোনাস কিভাবে নির্ধারিত হবে বা তারা কিভাবে বোনাস পেতে পারেন তার কোন আইনগত ব্যাখ্যা নেই।
মনজিল মোরশেদের মতে, শ্রম আইনের আওতায় থাকা বেসরকারি কোম্পানি বা কারখানা যেহেতু একটি মজুরি কাঠামোর আওতায় থাকে, তাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি মেনে চলা ও নিয়োগপত্র দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু এর বাইরে যে অসংখ্য বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা আছেন তাদের বোনাস পাওয়া সম্পূর্ণ নিয়োগকারীরা ওপর নির্ভরশীল।