ফেঁসে যেতে পারেন ৮০ জনপ্রতিনিধি

623

ফটিকছড়ির আবদুল্লাহপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হোসেন আলী তালুকদারের দেয়া জাতীয়তা সনদ ও ইসির ভোটার এনআইডি নিয়ে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন শফিউল খাইর। গত ৪ সেপ্টেম্বর তিনি পাসপোর্ট পেতে মনসুরাবাদ অফিসে এ আবেদন করেন। শনাক্তকরণ সফট্ওয়্যার সিস্টেমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মিল পাওয়া না গেলেও জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেন খাইর। পরে তাকে ডবলমুরিং থানায় সোপর্দ করা হয়।
এভাবেই প্রতিনিয়ত জনপ্রতিনিধিদের দেয়া জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয়তা সনদ ও ইসির ভোটার এনআইডি ব্যবহার করে পাসপোর্ট বানাতে তৎপরতা চালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ পর্যন্ত মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ৫৮ জন ও পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে ৭২ জন রোহিঙ্গার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। যারা প্রত্যেকেই পৌরমেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান এবং কাউন্সিলরদের কাছ থেকে জাতীয়তা সনদ ও জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করেছেন। এসব সনদ বুঝে না বুঝে অনেক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা সত্যায়নও করেছেন। দুই পাসপোর্ট অফিস থেকে রোহিঙ্গাদের আবেদনকৃত নথি সংগ্রহ করে অধিকতর তদন্তে নেমেছে দুদকের টিম। এতে সনদ দেয়ার প্রমাণ মিললে ফেঁসে যেতে পারেন ৮০ জনপ্রনিধি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৩ জন কাউন্সিলরও রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. আবু সাঈদ বলেন, জনপ্রতিনিধিদের সনদ নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট করতে আসে। এরমধ্যে আমরা যাদের সন্দেহ করেছি তাদের ফাইল জব্দ করে রাখি। প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতিনিধিদের দেয়া জাতীয়তা সনদ ও জন্মনিবন্ধন সনদ আনার পর আমাদের পাসপোর্ট দিতে বাধা থাকে না। কেউ কেউ আবার এনআইডি কার্ডও নিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক কিনা পুলিশ ভেরিফিকেশনেই এটি শনাক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় আমরা অনেক রোহিঙ্গাকে আটক করেছি। যার নথি দুদকের কাছেও দিয়েছি।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা পাসপোর্ট অফিস থেকে জনপ্রতিনিধিদের দেয়া কিছু নথি সংগ্রহ করেছি। এ সনদগুলো কারা দিয়েছে তা তদন্ত হচ্ছে। নাম ঠিকানা যাচাইবাছাই না করে সনদ দেয়া উচিত হয়নি। সনদ দেয়ার আগে অবশ্যই যাচাই করা উচিত ছিল, প্রকৃতপক্ষে মানুষগুলো কোথায় বসবাস করে।’
জানা যায়, পাসপোর্ট পেতে জনপ্রতিনিধিদের সনদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন করেছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজেলাগুলো থেকেই। এরমধ্যে সাতকানিয়ায় ১০ জন, পটিয়ায় সাতজন, বাঁশখালীতে পাঁচজন, চন্দনাইশে ছয়জন, লোহাগাড়ায় পাঁচজন, উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ছয়জন ও নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ২৩ জন কাউন্সিলর ছাড়াও কক্সবাজার, বান্দরবানের বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি একের অধিক রোহিঙ্গাকে বৈধতার সনদ দিয়েছেন। একই সনদ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেতেও ব্যবহার করেছেন রোহিঙ্গারা।
চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক দীপক চক্রবর্ত্তী পূর্বদেশকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কোনও জনপ্রতিনিধি ভুয়া সনদ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। স্থানীয় সরকার আইনেও তা বলা আছে। প্রমাণ মিললে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনের ২৩ জন কাউন্সিলর রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা সনদ দিয়েছেন। এ তালিকায় একজন প্যানেল মেয়রসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কাউন্সিলরও রয়েছেন।
উপজেলারগুলো মধ্যে সাতকানিয়ার আমিলাইষ ইউপির চেয়ারম্যান এইচএম হানিফ, কালিয়াইশ ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ওসমানী, এওচিয়া প্যানেল চেয়ারম্যান-১ আবদুল ওয়াহেদ, ঢেমশা ইউপি চেয়ারম্যান রিদুয়ান উদ্দিন, নলুয়া ইউপির চেয়ারম্যান তসলিমা আক্তার, কেওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনির আহমদ, সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের, চরতি ইউপি চেয়ারম্যান ডা. মুহাম্মদ রেজাউল করিম, কাঞ্চনা ইউপির চেয়ারম্যান রমজান আলী, প্যানেল চেয়ারম্যান মো. ছালাম, পটিয়ার পৌরমেয়র অধ্যাপক হারুনুর রশিদ, কাউন্সিলর রূপক কুমার সেন, শেখ সাইফুল আলম, ধলঘাট ইউপি চেয়ারম্যান রনধীর ঘোষ, কোলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আহমদ নুর, পটিয়ার জিরি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম সওদাগর, খরনা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, চন্দনাইশের হাশিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, সাতবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান আহমদুর রহমান, পৌরসভার মেয়র মু. মাহবুবুল আলম খোকা, কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ মো. মজিবুর রহমান, দোহাজারী ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বেগ, বাঁশখালীর সরল ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ চৌধুরী, বাঁশখালীর পুকুরিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন, ছনুয়ার প্যানেল চেয়ারম্যান-২ হাসমত আরা বেগম খুশি, কাথরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহাজাহান চৌধুরী, লোহাগাড়ার আমিরাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এনামুল হক এনাম, আমিরাবাদ ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, পদুয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. জহির উদ্দিন, ৬নং লোহাগাড়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুচ্ছাফা চৌধুরী, চুনতি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, ফটিকছড়ির রোসাংগিরি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালাম তালুকদার, নানুপুর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ ওসমান গণি বাবু, আব্দুল্লাহ ইউপির চেয়ারম্যান মো. হোসেন আলী তালুকদার, রোসাংগিরি ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম সোয়েব আল সালেহীন, হারুয়ালছড়ির সাবেক চেয়ারম্যান সরোয়ার আজম চৌধুরী, ফটিকছড়ি পৌরসভার মেয়র মো. ইসমাইল হোসেন, আনোয়ারা বরুমচড়া সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির আনছার, আনোয়ারার জুইদন্ডীর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোরশেদ রহমান চৌধুরী, কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা ইউপির চেয়ারম্যান হাজী ছাবের আহমদ, বোয়ালখালী পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আবু, বোয়ালখালীর শ্রীপুর-খর›দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম, রাউজানের উরকিরচর ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ আবদুল জব্বার সোহেল, কদলপুরের ইউপি চেয়ারম্যান তছলিম উদ্দিন চৌধুরী, হাটহাজারী পৌরসভার প্রশাসক, মির্জাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল আবছার, সীতাকুÐের সলিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন আজিজ, মিরসরাই মঘাদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন, স›দ্বীপের আমানউল্লাহ ইউপির চেয়ারম্যান মো. ইব্রাহিম, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউপি পরিষদ আ.স.ম শাহরিয়ার চৌধুরী, কক্সবাজার সদর পি.এম খালী ইউপির চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিম, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ইউপির চেয়ারম্যান সাবেক চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার, পেকুয়া বারবাকিয়া ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এ.এইচ.এম বদিউল আলম, বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি সদরের তছলিম ইকবাল চৌধুরী, ফাঁসিয়াখালী ইউপির জাকের হোসেন মজুমদার রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা ও জন্মনিবন্ধন সনদপত্র দিয়েছেন। এছাড়াও অনেক রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধিদের এমন সনদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনে ভোটারও হয়েছে। পাসপোর্ট আবেদনে জন্মসনদের পরিবর্তে কেউ কেউ দিয়েছেন ভোটার আইডি কার্ডও।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি নির্বাচন অফিসের সার্ভার ব্যবহার করে রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে তদন্তে নামে দুদক। দুদক তদন্তের অংশ হিসেবে পাসপোর্ট অফিস থেকেও নথি সংগ্রহ করে জনপ্রতিনিধের দেয়া সনদের সত্যতা যাচাইয়ে নামে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভোটার করিয়ে দেয়া ইসির সিন্ডিকেট চক্রকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।