ফূর্তি জার্নি

11

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

সকাল সকাল চেম্বারে শিশুটা যেন দেখে দিই- অনুরোধ-উপরোধ। ছোট্ট শিশু সারা রাত ভয়ার্ত চোখ মেলে ছিল। সেই সাথে থেকে থেকে প্রচন্ড কান্না।
শিশুসন্তান নিয়ে বাসে করে দীর্ঘ যাত্রার চেয়ে ট্রেনে সাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় বেশ। বিশেষত শিশুকে খাওয়াতে, তার পোষাক-আষাক পাল্টানোতে সুবিধা থাকে বেশি। যে কারণে শিশু,ও পরিবার নিয়ে নিরাপদ জার্নি হিসেবে রেলপথ বেছে নেন অনেকে। ‘ট্রেনে আর আগের সেই পরিবেশ নেই’Ñএমন কথা এখন শোনা যায়। তবুও জাহিদ সাহেব ঢাকা থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য বিরতিহীন ট্রেনের টিকিটই কাটলেন। ট্রেন ঝকাঝক শুরু হলে সব শিশু কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করতে থাকে। এদিক-ওদিক খানিকটা মুখ উঁচিয়ে দেখে। দু’এক কদম টলমল হেঁটে বেড়ায়। পরিবেশ পেলে মা-বাবার কোলে এক দু’পশলা ঘুম দিয়ে দেয়। আশ-পাশের সবাই তাকে ঘিরে মজা করে। কামরাতে থাকা এরকম দু’একজন শিশু আনন্দ দানের খোরাক হয়ে যায় বৈ কি! এটা ছিল শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত সংযোজিত বগি। ট্রেন ছাড়ার মিনিট দুই-তিন পূর্বে হৈ হুল্লোড় করে উঠে এল দশ-এগারো জন যুবক। যাদের গড় বয়স চব্বিশ-পঁচিশ এর কৌটায়। আসন খুঁজতে গিয়ে এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে এই বগিতে তাদের দুজনের সিট সংকুলান নেই। বরাদ্দ সিট অন্য কামরায়। কিছুটা নেতা গোছের একজন পাশাপাশি বসা দু’জন লোকের কাছে এসে টিকিট দুটো দেখিয়ে বলেÑ ‘আপনারা দু’জন এই কামরাতে চলে যান। আমরা সবাই তাহলে একসঙ্গে থাকতে পারব।’ লোক দু’জন কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলেন- ‘ওখানে যদি টি.টি আমাদের বসতে না দেন, বা কিছু বলেন?’ ‘আরে না না, কিচ্ছু বলবে না। আর কিছু বললে বলবেন আমরা ডি.ইউ এর স্টুডেন্ট।’ দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে ট্রেন। তার সাথে সাথে তুঙ্গে ওঠে যুবক দলের উচ্ছ্বাস আওয়াজের হৈ চৈ রব। চলে উঁচু ভলিউমে ছেড়ে দেওয়া গানের তালে তালে সশব্দ তবলা টোকা, হাততালি বাজনা, সুর-বেসুরো কান ফাটানো গান-চর্চা। বগির দক্ষিণ প্রান্তে পরিবার সমেত বোরকাবৃতা বেশ কিছুসংখ্যক নারী। অন্যপ্রান্তে এই যুবক দল। উদ্দেশ্য কক্সবাজার পরিভ্রমণ। মাঝখানের সিটগুলোও পরিপূর্ণ। যেখানে অন্য অনেকের সাথে শিশু সহ জাহিদের পরিবার। সারারাত ধরে যুবকদের উত্তাল কান্ডকারখানায় কেউ আর চোখের দু’পাতা এক করতে পারেনি। জাহিদের কন্যা শিশু মাঝে মাঝে ওদিকে তাকায়, ভয়ে বাবার বুকে মুখ গুঁজে দেয়, ডুকরে কেঁদে ওঠে। তবুও একজন বয়স্ক গোছের লোক তাদের উদ্দেশে বলতে আসেন- ‘দেখেন, কামরায় আরও কিছু মানুষজন আছে। ছোট বাচ্চা-টাচ্চাও। আপনারা যদি একটু নরম স্বরে কথাবার্তা বলেন তাহলে ভালো হয়।’ তাদের একজন চটজলদি মুখের উপর উত্তর ঢেলে দেয়- ‘আচ্ছা যান যান। সে আমরা দেখব।’ মানুষটা বিষণ্ণ মুখে ফিরে যেতে থাকলে যুবকদের মধ্যে একজনের মন্তব্য- ‘আরে মশাই, আমরা কি তোমার বয়সে এসে ফূর্তি করব?’ মা-বাবা অভিভাবকরা সন্তানদের এসব বেপরোয়া ফূর্তি জার্নির কথা কিছুই জানেন না। কখনো-সখনো বিপদ ঘটার খবর সংবাদ পাতায় মুদ্রিত হয়। এক গ্রুপ উপভোগের শেষে হয়তো ফেসবুক পোস্ট দেবে। তার সাথে প্রতিযোগিতা দেবে প্রতিদন্ধী আরেক গ্রুপ। তারা অন্য স্পট বেছে নিয়ে ফেসবুকে দেখিয়ে দিতে চাইবে তারা আরো বেশি হিরো। এদের মাথায় তখন ঘর, মা-বাবা পরিবার-পরিজনের প্রতি মায়া-দয়া, এক রক্তসাগরের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশের কথা মনে থাকে না।
বরং কীভাবে কীভাবে যেন গড়ে উঠছে আচার-ব্যবহারের এরকম বর্তমান সংস্কৃতি!
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।