ফুটপাত বেদখল, পথচারীরা সড়কে

63

সড়কের পাশেই পথচারীদের হাঁটার জন্য রয়েছে ফুটপাত। তবে সেই ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে দোকান ও বাসাবাড়ির আঙিনা হিসেবে। এমন ব্যবহারে পিছিয়ে নেই কাউন্সিলর অফিসও। নগরীর কাপাসগোলা রোড়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৬নং চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অফিসের নিচের ফুটপাতটি আঙিনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্র্র্তৃপক্ষ (সিডিএ) সড়ক প্রশস্ত করার সময় ভবন পুরো না ভেঙে নিচে ‘কোনো রকম’ ফুটপাত তৈরি করাতে এমনটা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর চকবাজার এলাকার তেলিপট্টি মোড় থেকে বাদুরতলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ভবনের নিচে ঢুকে পড়েছে ফুটপাত । তবে ফুটপাত নির্মাণের সময় স্থায়ীভাবে ভবন ভাঙা হয়নি। ফলে ফুটপাতগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে দোকান-ভবনের আঙিনা হিসেবে। অনেকে নিজের ভবনের শেষাংশে বেড়া দিয়ে ফুটপাত বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে পথচারীরা হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া যেসব ভবনের নিচের ফুটপাত বন্ধ করা হয়নি, সেখানে রাখা হয়েছে দোকানে মালামাল। অর্থাৎ এসব ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটার সুযোগ নেই। ফলে পথচারীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করছেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু বলেন, চকবাজার থেকে বহদ্দারহাট সড়কটি উন্নয়ন করে সিডিএ। সেসময় সড়ক প্রশস্ত করে ফুটপাত নির্মাণ করে তারা। তখন জায়গাও অধিগ্রহণ করে সংস্থাটি। তবে সিটি করপোরেশনের ভবন হওয়ায় পুরো না ভেঙে নিচ দিয়ে ফুটপাত নির্মাণ করেছিল। ফলে দেখতে অনেকটা আঙিনার মত লাগে। তবে ওই কাউন্সিলর অফিসের পাশেই ফুটপাত আঙিনা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন কি পদক্ষেপ নিয়েছে ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সড়কটি উন্নয়নের পর এখনও সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করেনি সিডিএ। ফলে এখনই আমরা পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তাছাড়া একই ওয়ার্ডের চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড কর্নার থেকে কাঁচাবাজার পর্যন্ত সড়কটির বেশিরভাগ দখল করে ইট-বালি বিক্রি করছে একটি চক্র। দৈনিক ও মাসিক চাঁদা দিয়ে এমন ব্যবসা প্রতিনিয়ত চললেও সড়ক দখলমুক্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের।
শুধু এই সড়ক নয় নগরীর বেশিরভাগ ফুটপাতই কোনো না কোনোভাবে বেদখল হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দখলের ভূমিকায় রয়েছেন হকাররা। ফুটপাতের পর সড়কের এক-চতুর্থাংশ দখল করে নেন তারা। তার উপর বাস-রিকশার স্ট্যান্ডবাজির কারণে দখলে থাকে বাকি সড়কের বেশিরভাগই। এসব অনিয়মের পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করে হকারদের সংগঠনগুলো। এছাড়া পুলিশের নিয়মিত চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিটি করপোশনের নির্ধারিত নিয়ম থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করছেন না হকাররা। ফলে নিউ মার্কেট মোড়ের যানজট ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের সবক’টি সড়কে। যার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির ফাঁক-ফোকর দিয়ে চলতে হয় পথচারীদের। আবার যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার কর্মঘণ্টা।
নিউ মার্কেট-রিয়াজউদ্দীন বাজার এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাতের দুই পাশে দুই সারি করে বসেছেন হকাররা। মাঝে সরু একটি পথ। যেটি ফুটপাতের উপরে হলেও পথচারীদের জন্য রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে ক্রেতাদের জন্য। বিক্রেতা আর ক্রেতার মাঝে পথচারীর অসহায় হওয়া ছাড়া আরও কোনো উপায় নেই। ফুটপাতের পর সড়কে আরও দুইদফা সারি করে বসেছেন হকাররা। প্রত্যেক সারির মাঝে রয়েছে ক্রেতাদের জন্য পথ। আবার এই সড়কেই রয়েছে অঘোষিত বাস স্ট্যান্ড। যেখানে হাটহাজারী থেকে আসা ৩নং বাস থামে। তবে তিন দফা হকারদের দখলের পর ক্রেতাদের জন্য খালি জায়গা রেখে বাসগুলো থেমেছে সড়কের মাঝখানে! এই মাঝপথে গাড়ি রেখে চালক-হেলপার ঘুমিয়েও পড়েন। এমন দখলের পর অবশিষ্ট রাস্তা দিয়ে চলে যানবাহন। ফলে নিয়মিত যানজটে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার কর্মঘণ্টা। শুধু তা-ই নয়, ফুটপাতের পথচারী বাধ্য হয়ে হাঁটছেন গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে আঁকাবাঁকা ফাঁক-ফোকরে। এটি শুধু নিউ মার্কেট বা রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার চিত্র নয়, তিনপুলের রাস্তার মাথা, বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ড ও কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত সড়কগুলোতে এমনই চিত্রের দেখা মিলবে প্রতিনিয়ত।
সিটি করপোরেশন বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের পর নিয়ম করেছিল বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ফুটপাতে হকাররা বসতে পারবেন। কিন্তু তার তোয়াক্কা না করে সারাদিনই ফুটপাত-সড়ক গিলে খাচ্ছেন হকাররা। প্রচলিত রয়েছে, পুরো শহরের ফুটপাত দখল করে হকারদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় নিউ মার্কেট এলাকা থেকে। নগর পরিকল্পনাবিদরা প্রায়শ বলেন, নিউ মার্কেট-রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার হকারদের শৃঙ্খলিত করা গেলে পুরো শহরের হকাররা শৃঙ্খলিত হবে। এ এলাকায় ৪টি হকারদের সংগঠন রয়েছে। তারাই মূলত নিউ মার্কেট রিয়াজউদ্দিন বাজারের ৩ হাজার হকার নিয়ন্ত্রণ করেন। অবশ্য, ফুটপাত ও সড়ক হকারদের দখলে রাখতে এসব সংগঠনের নেতারা অনেকটা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। নিয়মিত চাঁদা আদায় করে পুলিশকে ম্যানেজ করা তাদেরই দায়িত্ব। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র যেহেতু জনপ্রতিনিধি, তাই বিশাল একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে ভোটের সমীকরণে চাপে রাখে এসব সংগঠন।
ওই এলাকার বেশ কয়েকজন হকারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ১০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় সংগঠনগুলোকে। সে হিসেবে ৩ হাজার হকার থেকে বছরের আদায় করা হয় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এই বিশাল অংকের টাকা আদায় করা হয় শুধুমাত্র সংগঠনের অফিস খরচের জন্য। এছাড়াও তারা অভিযোগ করেন, প্রতিদিন পুলিশ আদায় করেন বিশ থেকে ত্রিশ টাকা। তবে উচ্ছেদ অভিযান হলে চাঁদার পরিমাণ আরও বেড়ে যায় বলে জানান হকাররা।
চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতির সভাপতি নুরুল আলম লেদু বলেন, আমি জানি ফুটপাতে হকাররা বিশৃঙ্খলভাবে বসছে। এটা আমরাও চাচ্ছি না। তবে হকারের চাহিদা রয়েছে। তাই হকার বন্ধ না করে শৃঙ্খলায় আনার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে শৃঙ্খলা ফেরাতে শুধু সাংগঠনিকভাবে মনিটরিং করে সম্ভব না। তাই আমার প্রস্তার পুরো শহরের থানা ইনচার্জদের সমন্বয়ে হকার নেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে একটি কমিটি করা দরকার। যারা সবসময় ফুটপাত মনিটরিং করবে। তাহলেই শৃঙ্খলা ফিরতে পারে বলে আশা করছি।