ফুটপাতে ২২১ দোকান বরাদ্দের দায় কার ?

148

ওয়াসিম আহমেদ

‘গাছ কেটে ফুটপাতে ৬৬ দোকান’ নিয়ে সিএনএ’র (চট্টগ্রাম নিউজ পেপার অ্যালায়েন্সের) অভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে গাছ কেটে ফুটপাত দখল করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) দোকান বরাদ্দের কথা। গত বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব দোকান বরাদ্দ কার আমলে হয়েছে, তা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এবং বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। প্রতিবেদনে সাবেক প্রশাসকের আমলে এসব দোকান বরাদ্দের কথা উঠে আসলেও তা অস্বীকার করে ‘দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে কারো বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা শোভন নয়’ মন্তব্য করে বিবৃতি দেন খোরশেদ আলম সুজন।
এমন বিবৃতি প্রকাশের পর ‘বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য আমাদের সকলের জন্য ক্ষতিকর’ জানিয়ে সিটি মেয়র প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘টেক্সটাইল ও তারাগেট এলাকায় চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি, শেরশাহ এলাকায় ৩১ জানুয়ারি তারিখে তিনটি এলাকায় মোট ২২১ দোকান বরাদ্দের ফাইল তৎকালীন প্রশাসক অনুমোদন করেন।’ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে কেউ দায় না নিলেও পূর্বদেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন কথা। গত বছরের ১৮ অক্টোবর সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দায়িত্বে থাকাকালে বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন শেরশাহ মেইন রোড, শিল্প এলাকা রোড, আবাসিক এলাকা এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে প্রায় ২০০ অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত করা প্রায় ৪০ শতক জায়গা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মারুফা বেগম নেলী ও স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) জাহানারা ফেরদৌস অভিযানে নেতৃত্ব দেন। জানা গেছে, জায়গাগুলো খালি হলে পুনরায় দখল করতে পায়তারা শুরু করে অবৈধ দখলদাররা। এমনকি সিটি করপোরেশনের মৌন সম্মতি নিয়ে তিন মাসের মাথায় আবারও দখল করে দোকান নির্মাণ শুরু করে তারা।
এ নিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে ‘বায়েজিদ শেরশাহ’র বিভিন্ন সড়কে দুইশ দোকান/উচ্ছেদের তিন মাস যেতেই আবার দখল’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন পূর্বদেশকে বলেছিলেন, ‘ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত হয়েছি। যারা দখল করেছে তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ফুটপাত দখল করে দোকান নির্মাণ কোনভাবে সহ্য করা হবে না। অবৈধ দখল ও দখলদারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সিটি করপোরেশন।’
ওনার বক্তব্যের ভিত্তিতে খবর নিয়ে জানা যায়, তৎকালীন এস্টেট অফিসার মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বায়েজিদ থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ‘বায়েজিদ সড়ক শেরশাহ মিনার রোডে সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজ চলমান। সড়কের দু’পাশে অজ্ঞাত ব্যক্তিগণ সিটি করপোরেশনের জমি জোরপূর্বক দখল করে দোকান নির্মাণ করছেন। সরেজমিনে গিয়ে কাজ বন্ধ পাওয়া গেছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাতের আঁধারে নির্মাণ কাজ করছে অবৈধ দখলদাররা। নির্মাণকারীদের কোনো পরিচয় জানা নেই। তবে সার্বিক বিবেচনায় মনে হয় নির্মাণকারীরা সেখানে পূর্বে অবৈধভাবে ব্যবসারত দোকানদার। বর্ণিত বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষে অভিযোগ দায়ের করার কথা উল্লেখ করেন মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী।’
অভিযোগ দায়ের করার মাত্র ৪ দিন পর সিটি করপোরেশনের উচ্চমান সহকারী আলী আকবর ফাইলে উত্থাপন করেন শেরশাহ রোড ব্যবসায়িক কল্যাণ সমিতির পক্ষে সভাপতি গোলাম সরোয়ার (রেজি-১৩৪৪/৮৮) উচ্ছেদকৃত ১০২টি দোকান আয়বর্ধক প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ চেয়েছেন। এমন তথ্য উত্থাপনের এক সপ্তাহের মধ্যে এস্টেট অফিসার, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার মতামতসহ ৩১ জানুয়ারি দোকানগুলো বরাদ্দের বিষয় অনুমোদন করেন তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। একইসাথে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ দ্বারা জায়গা চিহ্নিতকরণ করে এস্টেট শাখায় হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন। হস্তান্তরের পর জায়গাগুলো এস্টেট শাখা হতে বরাদ্দ ও ভাড়া আদায়, দোকান মালিকগণ নিজস্ব অর্থায়নের বাস্তবায়নের নিদের্শনার কথাও নথিতে লিপিবদ্ধ করেন সাবেক প্রশাসক। একইভাবে ফাইল উত্থাপনের মাত্র সাত দিনের মাথায় তারাগেট এলাকায় ৬৩টি দোকান বরাদ্দের অনুমোদন তিনি। একই দিনে টেক্সটাইল এলাকায় ৫৬টি দোকান বরাদ্দের ফাইল উত্থাপন করা হলেও ১ ফেব্রæয়ারি চূড়ান্ত অনুমোদন দেন সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদকৃত জায়গায় দোকান বরাদ্দের ‘গ্রীন সিঙ্গেল’ পেয়ে দোকা নির্মাণ শুরু করেছিল পূর্বের দখলদাররা। কিন্তু পূর্বদেশের প্রতিবেদক দখলের বিষয়টি তৎকালীন প্রশাসককে অবহিত করলে পরদিন উচ্ছেদ না করে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করে দায় সারেন। পরে ঠিকই ওসব ফুটপাত দখল করা ওসব দোকান বরাদ্দ দেন খোরশেদ আলম সুজন।
এসব বিষয় নিয়ে ওই সময়ের চসিকের এস্টেট অফিসার কামরুল ইসলাম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, গত বছরের অক্টোবরে শেরশাহ, তারাগেট ও টেক্সটাইল এলাকায় ফুটপাত থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়। পরে মানবিক আবেদন বিবেচনা করে ওসব এলাকায় হকারদের পুর্নবাসন করার সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। ভুক্তভোগীদের আবেদনের ভিত্তিতে দোকান বরাদ্দের নথি ওনার আমলে অনুমোদন হয়। একইসাথে প্রকৌশল বিভাগ দ্বারা জায়গা চিহ্নিতকরণ এবং এস্টেস শাখা দ্বারা দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। তবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ওনার আমলে ভাড়া ও সেলামি নির্ধারণ করা হয়নি। ততদিনে মেয়র মহোদয় (রেজাউল করিম চৌধুরী) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বরাদ্দের বিষয়টি আলোচনা করলে চসিকের সাধারণ সভায় উত্থাপন করার নির্দেশ দেন। ওই সময় সাধারণ উত্থাপন হলে সর্বসম্মতিক্রমে ভাড়া ও সেলামির বিষয়টি অনুমোতি হয়। তারই প্রেক্ষিতে তিনটি জায়গাতেই প্রতি স্কয়ার ফিট ১০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। শেরশাহ এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিট জায়গার জন্য ৪ হাজার টাকা সেলামি, তারাগেটে সাড়ে ৩ হাজার ৫শ টাকা এবং ট্রেক্সটাইলে ৩ হাজার টাকা সেলামি নির্ধারণ করা হয়। সেভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো চলমান ছিল বলে জানান সাবেক এস্টেট কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম।
ভাড়া নির্ধারণ ও সালামির বিষয়ে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক পূর্বদেশকে বলেন, ওই দোকান সম্পূর্ণ অনুমোদন দিয়ে গেছেন সাবেক প্রশাসক। অনুমোদিত বিষয়ে আমার করার কিছু ছিল না। তারপরও আপত্তি এড়াতে আমাকে বিষয়টি অবগত করা হলে সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় উত্থাপন করার নির্দেশ দিই। সে প্রেক্ষিতে উত্থাপিত হয় এবং সবার পরামর্শে ভাড়া ও সেলামি নির্ধারণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমি সহজে কারো বিরুদ্ধে বলি না। অনুমোদন দেওয়ার পর এভাবে মিথ্যা বলার কোনো মানে হয় না।