ফাটল দেখেননি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা

30

নিজস্ব প্রতিবেদক

এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের (বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার) আরাকান সড়কমুখি র‌্যাম্পের দুটি পিলারে ফাটল পায়নি বিশেষজ্ঞ দল। তবে অধিকতর নিশ্চিত হতে কারিগরি পরীক্ষা করবে দলটি। প্রয়োজনে ক্র্যাক হওয়া স্থানটি কেটে পিলারে ভেতরে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তাও দেখা হবে। ‘আন ফিনিশিং জয়েন্ট’ এর কারণে ফাটলের মতো দেখাচ্ছে। হাল্কা যান চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার এখনি খুলে দেওয়া যেতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা।
গতকাল বুধবার সকালে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন প্ল্যানিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট (ডিপিএম) এর কর্মকর্তারা বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার পরিদর্শন করে এসব তথ্য জানান। পরে বেলা একটায় ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনালের কনস্ট্রাকশন সাইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন প্ল্যানিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট (ডিপিএম) এর ডিরেক্টর মো. শাহজাহান।
তিনি বলেন, উপরে উঠে দেখলাম, ওটা ক্র্যাক না, কনস্ট্রাকশন জয়েন্ট। কনক্রিট করার সময় সেটা এক্সপোজ হয়ে যায়। ঢালাইয়ের সময় সাটারটা বের হয়ে আসে। মূল স্ট্রাকচারে কোনো সমস্যা নেই। নির্মাণ ত্রুটির কিছু না। তবে হয়ত আরও পলিশড হতে পারত কাজটা। বাইরে থেকে দেখা চিড়ের বিষয়ে তিনিও বলেন, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে সেটা ফোম। সাড়ে তিন বছর আগেও সেটা ছিল। হয়ত কেউ খেয়াল করেনি। তবে ভিতরে কোনো ক্র্যাক আছে কি না, তা আরও তদন্ত করে দেখব। ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনারের প্রজেক্ট ম্যানেজার মুনির হোসাইন বলেন, ডিজাইনার প্রতিষ্ঠানের দল পরিদর্শন করেছে। উনাদের অবজারভেশন হল, কলামগুলোতে যে ফাটল দেখতে পাচ্ছি, সেটা ফাটল না। এটা কনস্ট্রাকশন জয়েন্ট। কলামের সাথে টেক্সচারের কাস্টিংয়ের যে জয়েন্ট, সেই স্যাটারিংটা প্রপার পজিশনে ছিল না। কাস্টিং করার সময় ডিসপ্লেস হয়ে গেছিল। যার কারণে একটা স্পেস সৃষ্টি হয়। সাটার টু সাটার জয়েন্টে ফোম ব্যবহার করা হয়। যাতে কোনো ওয়াটার লিকেজ না হয়। সেই ফোমটা আছে। এতদিন হয়ত চোখে পড়েনি। অরিজিনালি এটা কোনো ফাটল না।
র‌্যাম্পের অবকাঠামোগত কোনো ক্ষতি হয়নি দাবি করে মনির বলেন, ফিজিক্যালি চেক করে কিছু পায়নি। আরও নিশ্চিত হবার জন্য যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে, ভেতরে কোনো ফাটল আছে কী নেই? উনাদের (ডিপিএম) পর্যবেক্ষণ এখনও শেষ হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লিখিতভাবে সিডিএকে জানাবে।
তিনি আরও বলেন, ফ্লাইওভারের এ অংশটি মূল নকশায় ছিলো না। ফ্লাইওভার নির্মাণের চার বছর পর তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের অনুরোধে আমরা আরাকান সড়কমুখি এই র‌্যাম্পটি তৈরি করেছিলাম। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই র‌্যাম্পটি তৈরি করা হয়। হাল্কা যান চলাচলের জন্য র‌্যাম্পটি তৈরি করা হলেও ভারী যান চলাচলের কারণে এটি ঝুঁকিতে আছে। হাল্কা যান চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার এখনি খুলে দেওয়া যেতে পারে।
সিডিএ’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দুয়েকদিনের মধ্যে হাল্কা যানবাহন চলাচলের জন্য র‌্যাম্পটি খুলে দেওয়া হবে। ভারী যানবাহন যাতে চলাচল করতে না পারে সেজন্য তৈরি করে দেয়া হবে ব্যারিয়ার। ব্যারিয়ার তৈরির পর যান চলাচলের জন্য নির্দেশনা দেয়া হবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা আসলে বিশেষজ্ঞ দলের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন ফাটল বলা হচ্ছে, তখন আমরাও মনে করেছিলাম ফাটল। এখন বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শন করেছে, তারা ফাটলের কোনো কিছু পাননি। এটি ছিলো পুরোটা গুজব।
এর আগে ২৫ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে ফাটল মনে করে চান্দগাঁও থানা পুলিশ আরাকান সড়কমুখি র‌্যাম্পে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরেরদিন পরিদর্শনে গিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী নির্মাণ ত্রæটির কারণে এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ওইদিন বিকেল পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমানও বলেন, ভারী যানবাহন চলাচল অথবা নির্মাণকাজে ভুল থাকার কারণে পিলারে ফাটল হতে পারে। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি আবার দাবি করেন, যেটিকে ফাটল বলে আলোচনা করা হচ্ছে বাস্তবে সেটা ফাটল নয়, এটি ‘ফলস কাস্টিং।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের মার্চে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মীর আক্তার-পারিশা (জেভি) কনস্ট্রাকশন। মীর আক্তার প্রধান অংশীদার হলেও মূল কাজ করে পারিশা। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করার সময় ২০১২ সালের ২৯ জুন একটি গার্ডার হঠাৎ ধসে পড়ে। এতে একজন রিকশাচালক সামান্য আহত হন। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন নিহত হন। এ ঘটনার পর সিডিএ’র প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী এএম হাবিবুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তাকে মামলার আসামি করা হয়। প্রথমে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯১ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ১০৬ কোটি টাকা করা হয়। ফের সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ১২০ কোটি টাকা করা হয়। ১ হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারটির প্রস্থ ১৪ মিটার। চার লেনের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুই পিলারের দূরত্ব ১৩০ ফিট। শুরু থেকে ফ্লাইওভারটির প্রতি মানুষের অনীহা দেখা গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে আতঙ্ক তৈরি হয়। সে আতঙ্ক কাটিয়ে যানবাহন ফ্লাইওভারমুখি হতে শুরু করার পর নতুন করে পিলারে ফাটল নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। পিলারে ফাটল আতঙ্ক থেকে সরে আসতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।