ফাঁসি বা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে

32

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় ১০ আসামির সবার মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।
এই রায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদন্ডাদেশের (ডেথ রেফারেন্স) অনুমোদন দিয়েছে হাই কোর্ট। তবে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরে বিচারিক আদালতের দেওয়া আদেশ পরিবর্তন করে দিয়েছে।
ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম ২০১৭ সালের অগাস্টে এ মামলার রায়ে ‘হাই কোর্টে বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে গুলি করে’ দশ আসামির দন্ড কার্যকর করতে বলেছিলেন।
আসামিদের ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি আসামিদের সবার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত ৮৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কোনো পদ্ধতি (ফায়ারিং স্কোয়াডে বা ফাঁসে ঝুলিয়ে) অনুসরণ করে দন্ডিত ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে পারবে।
এর ব্যাখ্যায় উচ্চ আদালত বলেছে, গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নজির যেহেতু খুব একটা দেখা যায় না, সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয় পদ্ধতির যে কোনো একটি অনুসরণ করে তা কার্যকর করতে পারে।’
ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে হবে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। আর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে মৃত্যুদন্ড হলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা মৃত্যু পর্যন্ত গুলি চালিয়ে তা কার্যকর করা যাবে।
তবে বাংলাদেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের কোনো নজির নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে জজ আদালত আসামিদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে বললেও হাই কোর্ট তা বদলে দিয়েছিল।
সে প্রসঙ্গ তুলে ধরে কোটালীপাড়ার মামলায় হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একমাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উভয় পদ্ধতির যে কোনো একটি অনুসরণ করার কথা বিচারিক আদালত আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াডে জনগণের উপস্থিতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে না থাকায় হাই কোর্ট বিভাগ ওই আদেশ পরিবর্তন করে শুধু দন্ডিত ব্যক্তির গলায় রশি ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ দেয়।’
হাই কোর্ট বলেছে, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪-এ ধারায় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দু’ধরনের পদ্ধতি থাকলেও বর্তমান মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক দন্ডিতদের গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আদেশ দেন। এ ধরনের পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নজির যেহেতু খুব একটা দেখা যায় না, সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয় পদ্ধতির যে কোনো একটি অনুসরণ করে তা কার্যকর করতে পারে। সুতরাং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ড কার্যকর সম্পর্কিত আদেশ পরিবর্তন করা হলো।’
হাই কোর্টে এ মামলার শুনিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ। তাদের সঙ্গ ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ মোহাম্মদ শাহীন মৃধা।
আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও মোহাম্মদ আহাসান, ইমাদুল হক ও নাসির উদ্দিন। আর পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী অমূল্য কুমার সরকার।
এ মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক ওরফে মারফত আলী, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান ওরফে শিমন খান, ইউসুফ ওরফে মোসাহাব মোড়ল ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই ও মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ওমর।
এছাড়া দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলার আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানকে দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং আনিসুল ইসলামকে দেওয়া ১৪ বছরের কারাদন্ডও বহাল রেখা হয় হাই কোর্টের রায়ে।
আর ১৪ বছরের সাজায় দন্ডিত মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানের দন্ড বহাল রেখে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার ১৪ বছর দন্ড ভোগ করা হয়ে গেছে। জেল কোড অনুসারে এ আসামি যদি দন্ড ভোগ করে থাকেন, তাকে মুক্তি দিতে (যদি অন্য কোনো মামলা না থাকে) নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ১৪ বছরের সাজায় দন্ডিত অপর আসামি সারোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দেয় উচ্চ আদালত। যদি অন্য মামলা না থাকে, তাহলে তাকেও মুক্তি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে।
২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায়। পরদিন ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয় কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাড থেকে। তার এক দিন পর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত ওই কলেজ মাঠে জনসভায় শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল।
ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপপরিদর্শক নূর হোসেন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করেন।
সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্ত শেষে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল যে অভিযোগপত্র দেন, তাতে আসামি করা হয় ১৬ জনকে। পরে ২০০৯ সালের ২৯ জুন নতুন করে ৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। খবর বিডিনিউজের
গোপালগঞ্জের আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্রটি যখন দেওয়া হয়, ততদিনে ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ৪১ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মামলা দুটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
২০১৭ সালের ২০ অগাস্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম রায়ে ১০ জঙ্গির প্রাণদন্ড দেন। এছাড়া চার আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেন তিনি।
২০১৮ সালের ২ এপ্রিল উচ্চ আদালতে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডের রায়ের অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়। এ বছর ১৭ ফেব্রæয়ারি রায় দেয় হাই কোর্ট।
শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে মুফতি হান্নানকে দায়ী করা হয়। শেখ হাসিনার নিজের জেলা গোপালগঞ্জেই মুফতি হান্নানের বাড়ি। পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে তার জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি। আফগানিস্তান সীমান্তে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এই জঙ্গি নেতা কারাগারেই ছিলেন। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যার চেষ্টায় গ্রেনেড হামলার ঘটনায় চলতি বছর ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বোমাগুলো উদ্ধারের সময় মুফতি হান্নানের মালিকানাধীন গোপালগঞ্জে হেমাঙ্গন আবাসিক এলাকার ভাড়া করা একতলা বাসা থেকে বোমা বানানোর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়েছিল হান্নানের সোনার বাংলা সাবানের কারখানা থেকে।