‘ফাঁদ অভিযানেই’ বেশি সফল দুদক

52

গতবছর সারাদেশে মোট একশ’ ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে হটলাইন বা টোল ফ্রি নম্বর-১০৬- এ পাওয়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ‘ফাঁদ পেতে’ অন্তত ২৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেবল চট্টগ্রামেই ধরা পড়েছেন এক আনসার কমান্ড্যান্টসহ সাতজন। দুদকের এই ফাঁদ অভিযান পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর বেশিরভাগই তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে।
দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত তিন বছরে দুর্নীতি সংক্রান্ত নানা অভিযোগের মামলায় মোট গ্রেপ্তার করা হয় সাতশ’ ৪৯ জন আসামিকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে মোট আসামি গ্রেপ্তার হয়েছিল একশ’ ৮২ জন। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ৫৭ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইবছর গ্রেপ্তারের সংখ্যা অনেকটা হ্রাস পেলেও সদ্যবিদায়ী ২০১৯ সালে তা পুনরায় বেড়েছে। বিদায়ী বছরে দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় মোট আসামি গ্রেপ্তার হয় একশ ২৩ আসামিকে। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারি, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য, সাব-রেজিস্ট্রার, কর কর্মকর্তাসহ নানা পেশার ব্যক্তিরা রয়েছেন। একইভাবে ২০১৭ সালে ফাঁদ পেতে দুদক ঘুষের টাকাসহ ২৪ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৮ সালে ফাঁদ অভিযানের মত গ্রেপ্তারের সংখ্যাও ১৫ জনে এসে নামে। তবে, বিদায়ী ২০১৯ সালে এই সংখ্যা বেড়েছে। ফাঁদ পেতে ঘুশের টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয় ২৫ জনকে। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামেই গ্রেপ্তার হয়েছেন সাতজন।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য পূর্বদেশকে বলেন, ফাঁদ মামলার তদন্ত যথাসময়ে শেষ করেই আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়ে থাকে। বিদায়ী বছরের শেষের দিকের কয়েকটি মামলা ছাড়া বাকিসব ফাঁদ মামলার চার্জশিট ইতিমধ্যে দাখিল করা হয়েছে। বেশকিছু মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে সর্বশেষ বিদায়ী বছরের ২৪ ডিসেম্বর অভিযোগের ভিত্তিতে ফাঁদ পেতে ঘুষের নগদ ১৫ হাজার টাকাসহ আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের সহকারী নিয়ন্ত্রক আল মাহমুদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগ্রাবাদ সরকারি কার্যভবন-১ এর নিজের কার্যালয় থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে দুদক। ফাঁদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম। আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি) নবায়নের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত¡াধিকারীর কাছে থেকে নেয়া ঘুষের নগদ ১৫ হাজার টাকাসহ নিজের কার্যালয় থেকে ওই কর্মকর্তাকে দুদক গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন দন্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় একটি মামলা করেন।
এর আগে ওই বছরের ৫ নভেম্বর আগ্রবাদের বিএইপি ভবনে দুদকের ফাঁদ অভিযানে গ্রেপ্তার হন কর অঞ্চল-২ ও আয়কর সার্কেল-৩১ – এর পরিদর্শক রেজাউল করিম। ঘুষের নগদ ২০ হাজার টাকাসহ তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এর দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর বিকালে ‘ঘুষের টাকা লেনদেন হচ্ছে’- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক সমন্বিত কার্যালয়- ২- এর সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশের নেতৃত্বে দুদক টিম নগরীর ষোলশহর এলাকার শপিং কমপ্লেক্সের ‘আনুকা’ নামের একটি কাপড়ের দোকানে অভিযান চালায়। ওই দোকানে তল্লাশি চালিয়ে নগদ সাড়ে সাত লাখ টাকা এবং ৯০ লাখ টাকার আটটি চেক এবং জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কিত বেশকিছু নথিপত্র জব্দ করা হয়। এ সময় চারজনকে আটক করা হলেও পরবর্তীতে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি ও জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার সাবেক শিকলবাহক মো. নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগী তসলিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তারও আগে গত ৩০ অক্টোবর দুদক ‘ফাঁদ পেতে’ জেলার বাঁশখালীর গুণাগরীর কোকদন্ডী ভূমি অফিসে ঘুষের ৬২ হাজার টাকাসহ নুরুল আলম ছিদ্দিকী নামে একজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। এ সময় তিনটি খালি চেক এবং অফিসের বিভিন্ন নথিও জব্দ করা হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা উপজেলার চাতরী চৌমুহনী বাজারের বাসায় ফাঁদ পেতে সেটেলমেন্ট অফিসের সার্ভেয়ার মো.শহীদুল হককে গ্রেপ্তার করে দুদক। জমির খতিয়ান সংক্রান্ত একটি সমস্যা সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সর্ভেয়ার শহীদুল এক সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের শরণাপন্ন হলে ওই সেবাগ্রহীতাকে দিয়েই দুদক ফাঁদ পাতে। ৭০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করেন ওই সেবাগ্রহীতা। ঘুষের অগ্রিম বাবদ অর্থ লেনদেনের সময় বাসার বাইরে অপেক্ষমাণ ছিল দুদক টিম। এরপর ঘুষের ওই টাকাসহ সার্ভেয়ার শহীদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের শুরুতেই ২৪ জানুয়ারি আগ্রাবাদে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে গিয়ে ঘুষের নগদ এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন নীলফামারীর আনসার-ভিডিপির জেলা কমান্ড্যান্ট মো. আশিকুর রহমান। তিনি বান্দরবানের লামায় কর্মরত থাকাবস্থায় প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সংস্কার কাজ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুদক। সেই অনুসন্ধান নিজের অনুকূলে নিষ্পত্তি করার জন্য দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপসহকারী পরিচালক জাফর সিদ্দিক শিবলীকে নগদ এক লাখ টাকা ঘুষ সাধেন আশিকুর রহমান। তাকে অপেক্ষায় রেখে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট বিভাগে জানানো হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ঘুষের এক লাখ টাকাসহ আশিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
দুদকের ফাঁদ অভিযানে ঘুষ লেনদেন পুরোপুরি নির্মূল না হলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও সেবাগ্রহীতাদের কাছে একটি বার্তা হয়তো পৌঁছানো গেছে বলে মনে করে সনাক চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারি পরিষেবায় ঘুষ লেনদেন বন্ধে ফাঁদ অভিযান আরও জোরালো করা দরকার। চলতি বছরে দুদক সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে বলে আমরা আশা করতে চাই।