ফরাসি বিপ্লব ও শিল্পী দেলাক্রোয়া

219

যে কোনও দেশের বিপ্লব, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি কাজ করে থাকেন সে দেশের চারুশিল্পী, নাট্যশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সৃজনশীল ব্যক্তিরা, যাকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অপসংস্কৃতির জড় দৃশ্যপট পরিবর্তন করে ঐতিহ্য, স্বকীয়তা, জাতীয়তাবাদ, মুক্তচিন্তা, মানবিকতা, কালের চাহিদায় ও ভবিষ্যতের সংকল্প বিশেষভাবে উদ্ভাসিত হয় অসাধারণ সৃষ্টিসমূহ, অমরত্ব লাভ করে তাদের সৃষ্টি কালজয়ী শিল্পকর্মসমূহ, যা কালের পটে খোদিত হয়ে থাকে হিরন্ময় স্মৃতিতে।
ইতালীয় রেঁনেসা ইউরোপের সংস্কৃতিতে তথা নুতন চিন্তা, দর্শন ও মননের বিষয়টি বিস্তার লাভ করতে কিছু সময় লেগেছিল। ধর্মীয় কুসংস্কার, বিধি, কুক্ষিগত অর্থনীতি, বিলাসিতা, অপশাসন ও শাসন ব্যবস্থায় অসংগতিতে সাধারণ মানুষের অধিকার বার বার বঞ্চিত হয়েছে, রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদের কষাঘাতে ভেঙ্গে পড়েছিল সমাজের সুদৃঢ় বন্ধন দীর্ঘকাল।
ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে রাজতন্ত্র, বুর্জুয়া, পতি-বুর্জুয়ার তোরণে শক্ত আঘাত হেনেছিলেন দেশের সাধারণ জনগণ। স্বৈরশাসক ও জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে এই দিনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে বিশ্বব্যাপী। বলা হয়ে থাকে, সম্রাট ষোড়শ লুই এর আমলে ভোগবিলাসের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় ও অতিবিলাসি জীবনযাপন সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবন হাঁফিয়ে উঠেছিল। করের বোঝা ছিল অসহনীয়। চাষের জমিসমূহ গির্জা বা সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে নিয়ে চাষাবাদ করতে হতো সাধারণ চাষিদের। সেদিন ছিল ১৪ জুলাই, ভার্সাই নগরের বাস্তিল প্রাসাদে অগ্নিফুলিঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফরাসি জনগণ- তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রকাশ ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। বাস্তিল দুর্গ পতনের পর সূচিত হয় সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও আধুনিক ফরাসি দেশের নতুন মাত্রায় যাত্রা। এই দিনটিকে ফরাসিরা ‘বাস্তিল দিবস’ বা ‘ফেত ন্যাশিওনাল’ বা ‘জাতীয় দিবস’ বা ‘ক্যাথোজ দ্য জুইলে’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ফরাসিরা ১৭৯০ সাল থেকে ‘বাস্তিল দিবস’ পালন করে আসছে। পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের এক ঐতিহাসিক বিজয়ের সাক্ষী হিসেবে যে স্লোগানটি স্থান করে নেয় তা হলো-‘স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী’ এই মন্ত্র।
ফরাসি রাষ্ট্রপতির সম্মুখে প্যারিসের শঁজলিজে অ্যাভেনিউতে ১৪ জুলাই সকালে দিবসটি পালন করার প্রথা প্রচলন আছে। যেখানে চলে একোল পলিতেকনিক, একোল স্পেসিয়াল মিলিতর দ্য সাঁ-সির, একোল নাভাল ইত্যাদি বিদ্যালয়সমূহের কুচকাওয়াজ, সাধারণ সৈন্যদের কুচকাওয়াজ, সাঁজোয়া গাড়ির পরিবহন ইত্যাদি। আকাশে উড়ে পাত্রূই দে ফ্রঁসের ত্রি-রং এর ধোঁয়ায় আঁকা জাতীয় পতাকা। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই উদ্যাপন করা হয় সীমিত আকারে প্যালাস দ্যো লা কনকডে। এই প্যারেডে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি পতাকার সামনে দাঁড় করানো নার্স, ডাক্তার, সুপার সপ ইত্যাদির বিভিন্ন ব্যক্তিদের সম্মান জানানো হয়, যারা বিশ্ব মহামারি কোভিড-১৯ কালীন সময়ে মানুষের পাশে থেকে সহায়তা দিয়েছিলেন।
শিল্পকলার দেশ ফ্রান্স তাদের সাধারণ জীবনযাপনে শিল্পের ছোঁয়া পেতে ভুল করে না। নবীণদেরকে সামনে এনে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে এবং প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে যথাযথভাবে চেষ্টা করে। অষ্টাদশ শতকের এমন একজন শিল্পী যার নাম ‘দেলাক্রোয়া’ পুরো নাম ফারদিনান্দ ভিক্টোর উগেন দেলাক্রোয়া। তাঁর জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৭৯৬, সেইন্ট মউরিস, ফ্রান্স এবং ১৮৬৩ সালের ১৩ আগস্ট প্যারিসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রোমান্টিসিজম ও রোমানেস্কো ধারায় চিত্রকর্ম রচনা করতেন। এছাড়াও লিথোগ্রাফ এর প্রতি ছিল তাঁর দুর্বলতা। ‘লিবার্টি লিডিং দা পিপল’ শিল্প কর্মটি তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম আখ্যায়িত করা হয়। যা ফরাসি বিপ্লবের গাঁথাকে চির ভাস্বর করে রেখেছে। তাঁর এই ক্যানভাসে একজন মহিলা অনাবৃত বক্ষে দাঁড়ানো। তার বাম হাতে বেয়নেড সজ্জিত রাইফেল, ডান হাতে ফরাসি পতাকা উপরের দিকে তুলে ধরেছেন। তার মাথাটি ডানদিকে ঘোরানো, সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় ‘পাইরাজিয়ান ক্যাপ’ বা ‘লিবার্টি ক্যাপ’। অসংখ্য মৃত শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গিতে শায়িত স্তুপের ঠিক পিছনে তার অবস্থান। ছবির সামনে নিচের দিকে দুটি মৃত শবীর দেখা যায়। যাদের দেখে অভিজাত মনে হয়। এই চিত্রে যে ছোট ছেলেটি দেখা যায় তার দুহাতে দুটি পিস্তল ও কাঁধে একটি থলে আছে, সেও তার ডান হাত উঁচিয়ে পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়ছে ধোঁয়ার মধ্যে। তার পিছনে অস্পষ্ট প্যারিসের নটরডেম স্থাপত্য দৃশ্যমান যেখানে ত্রি-রং এর ক্ষুদ্র উড়ন্ত পতাকা দেখা যায়। এই ছেলেটি একোল পলিতেকনিক এর ছাত্র বলে ধারণা করা হয়। নারীর ডান পাশে কালো হেট মাথায় বন্দুক হাতে যে পুরুষ, তা শিল্পী নিজেকেই তুলে ধরেছেন বলে অনেক শিল্প সমালোচকরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। এই নারীর সামনে নতজানু হয়ে হাতের ওপর ভার দিয়ে তার দিকে তাকানোর ভঙ্গিতে মনে হয়, স্বাধীনতা বা মুক্তির আশার আকুলতা। শিল্পকর্মের প্রধান নারীটিকে ‘মারিয়ান’ নামে অভিহিত করা হয় যা স্বাধীনতার উন্মুক্ত প্রতীক। এই নারীর মুখমন্ডল ফরাসি জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়। বলা হয়ে থাকে, অতি স্বল্প সময়ে লুই এর বিরুদ্ধে এই বিজয় দ্বিতীয়বার প্রজাতন্ত্রের গৌরব উজ্জ¦ল বিজয়।
শিল্পী দেলাক্রোয়া এই আন্দেলনে অংশগ্রহণ করেননি, তিনি এই মহান বিজয়কে সম্মান ও মহিমান্বিত করার জন্য এমন সৃষ্টিশীলতার প্রয়াস করেছেন। বিপ্লব, আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কঠোর শৃঙ্খলিত জীবনবৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার উদাহরণ এই মহৎ সৃষ্টি। শিল্পী অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, যদিও এই বিপ্লবে তিনি স্বশরীরে অংশগ্রহণ করতে পারেননি কিন্তু এই বিপ্লবের প্রতি ছিল তারও অধিকার, এ বিপ্লব নিজেরও। রোমান্টিসিজম ধারায় তিনি তার বিষয় উপস্থাপনা রং এবং রেখার ব্যবহারে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ, সংগ্রামের প্রতি অনড় অবস্থান, দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি রং এর বৈচিত্রতা কম্পোজিশনে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ভালোবাসতেন শেক্সপিয়র, লড বায়রন এর রচনাশিল্প, মিকেলেঞ্জেলোর প্রতি ছিল বিশ্বাস, বেটোফেনের ‘পেস্টোরাল’ তাকে আকৃষ্ট করতো অনেক বেশি। তাই বিশালত্বের ধ্বনি ও অতলতার ছোঁয়া তাঁর অসংখ্য সৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া যায়।
দেলাক্রোয়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কজের মধ্যে ‘ম্যাদমোয়াজেল রোজ’-১৮১৭-১৮২৪, ‘দি ওমেন অফ আলজেরিয়ান’-১৮৩৪, ‘দি ডেথ অফ জেসডেমোনা’-১৮৫৮, ‘দি ব্যাটেল অফ তালেবওর’-১৮৩৪-১৮৩৫ ইত্যাদি। ‘লিবার্টি লিডিং দ্যা পিপল’ শিল্পকর্মটির পরিমাপ ২৬০ সেন্টিমিটার ও ৩২৫ সেন্টিমিটার ক্যানভাসে তৈল রং মাধ্যমে করা, সময়কাল ১৮৩০ খিষ্টাব্দ। যা লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ফরাসি টাকা, পয়সা, স্ট্যাম্প ও অসংখ্য পোষ্টারে এই শিল্পকর্মের ছবি ছাপা হয়েছে। আমেরিকায় অবস্থিত ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’, ‘লিবার্টি লিডিং দ্যা পিপল’ এর সেই স্বাধীনতার দেবী থেকে ভাস্কর ফ্রেডেরিক আগুস্ত বার্থোলডি অনুপ্রাণিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই শাশ্বত নান্দনিক শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণায় অনেক কবি শিল্পী সাহিত্যিক শোষণের বিপক্ষে, বঞ্চনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, স্বাধীকারের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন সৃষ্টিশীলতায় ব্রতী হয়ে নতুন প্রত্যয়ে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে প্যারিসের লুভ মিউজিয়ামে আমাকে ‘লিবার্টি লিডিং দ্যা পিপল’ শিল্পকর্মটি দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন অঁলিয়স ফ্রঁসেস চট্টগ্রামের পরিচালক ড. সেলভাম থোরেজ ও ড. গুরুপদ চক্রবর্তী। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্যারিসে আমাকে সার্ব্বক্ষণিক যোগাযোগ ও উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য সতীর্থ শিল্পী আজম-মুনিরা পরিবারকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।