ফন্দি

30

কলেজ ছুটির পর সোজা বাসার পথে ছুটছে মীরন। সূর্য ঠিক মাথার উপর। প্রচন্ড গরমে শরীর থেকে অনবরত ঘাম বেরুচ্ছে। এমনিতেই তার গরম সহ্য হয় না। তার উপর বাংলার ঋতুর পালা বদলের খেলায় এখন গ্রীষ্মকাল। বাংলার প্রকৃতিতে চলছে সূর্যের প্রখরতার রাজত্ব। ওদিকে তার খুব পিপাসাও লেগেছে। কিছুপথ অতিক্রম করার পর নেভী স্কুলের সামনে রাস্তার ধারে একটি টং-দোকান দেখতে পায়। এরপর বাইকটা একটু ঘুরিয়ে একপাশে দাঁড় করিয়ে টং-দোকানের দিকে এগিয়ে আসে সে। আশপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এ মুহূর্তে এখানে অনেক মানুষের ভীড়ে পরিচিত কেউই নেই। স্টুডেন্ট লাইফে এই টং-দোকানগুলোই ছিল সবচেয়ে প্রিয় আড্ডার জায়গা। এখন সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। পরির্বুন এসেছে চলাফেরায়ও। শহরের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে। এ সুবাদে সমাজের উঁচুনিচু সবশ্রেণি পেশার মানুষের সাথে নিত্য উঠাবসা করতে হয় তাকে। সবাই ‘স্যার’ হিসেবে মান্য করে। এখন আর মন চাইলেই যেখানে সেখানে বসা যায় না। কিন্তু আজ কেন জানি, কোন বাঁধাই তাকে আঁকাতে পারলো না। দোকানীকে এককাপ চা দিতে বলে সম্মুখের ফিল্টার থেকে এক গøাস পানি নিজ হাতে ঢেলে নিয়ে পান করতে লাগলো সে। অল্প কিছুক্ষণ হলো নেভী স্কুল ছুটি হয়েছে। দোকানীও চা বানাতে বেশি সময় নিচ্ছে। মীরন দোকানীকে তাড়া আছে বললে দোকানী “দিচ্ছি স্যার” বলে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁকে মীরনের চোখে ধরা পড়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাগুলোর দিকে।
রাস্তায় খুব জ্যাম। এরিমধ্যে একটা রিক্সা মীরনের মোটরবাইকের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সায় বসে আছেন আধাবয়সী একজন মহিলা। মহিলাটি বামহাত দিয়ে ছোট একটি ছেলেকে ধরে মোবাইলে কথা বলছেন। ছেলেটির বয়স বছর চার কি পাঁচ হবে। সম্ভবু প্লে/নার্সারিতে পড়ে। ছেলেটি তার মায়ের সাথে অস্পষ্টভাবে কি যেন বলতে চাইছে। কিন্তু মা ফোনালাপে ব্যস্ত। মীরন আরো মনোযোগী হয়ে বাচ্চাটির কথা শুনতে কান খাড়া করে রাখে। হঠাৎ তার কানে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাওয়ালার গলার আওয়াজ ভেসে আসে। রিক্সাওয়ালা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। রিক্সাওয়ালা বলছে,
– তাহলে তোরা কলসির দিঘির মোড়ে অপেক্ষা কর। আমার আসতে আরো আধাঘন্টা সময় লাগতে পারে। এই কথা বলে সে রিক্সার কাছে চলে আসে।
বিষয়টি নিয়ে মীরন রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেল। মীরন ভাবতে লাগলো, রিক্সাওয়ালা এতক্ষণ কার সাথে কথা বলেছে? রিক্সাওয়ালার কথার মধ্যে কেমন যেন ষড়যন্ত্রের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।
মহিলাকেও চিনিনা। কিভাবে তার সাথে কথা বলি? প্রমাণ ছাড়া রিক্সাওয়ালাকেও কিছু বলা যাচ্ছে না। শেষে ঝামেলা পাকিয়ে দেবে। ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বাচ্চাাঁর দিকে তাকিয়ে আছে সে। ওদিকে চা দোকানী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেশ কয়েকবার তাকে ডাকে।
মীরন দোকানীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চিন্তিত মনে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। এরপর কাপটা পাশের টেবিলের ওপর রেখে বসা থেকে দাঁড়ায়। তার মনে হতে থাকে বাচ্চাাঁ তার মায়ের কাছ থেকে একটু দূরে সরে এসেছে। মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে নিচে পড়ে যেতে পারে। তড়িগড়ি করে সে দৌড়ে আসে রিক্সার কাছে। বাচ্চাটিকে সত্যি সত্যি পড়ে যেতে দেখে অমনি ধরে পেলে সে। ততক্ষণে মহিলাটি মোবাইলে কথা বলা বন্ধ করে বাচ্চা আর মীরনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মীরন বাচ্চাটিকে তার মায়ের কোলে তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আপা, আপনারা কোথায় যাবেন?
মীরনের এমন প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তির চিহ্ন মুখে এনে মহিলা বললেন,
– কেন ভাই? কি হয়েছে?
– না, একটু বলেন না, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
মহিলাটি অনিচ্ছা সত্তে¡ও বলল,
– আমরা আগ্রাবাদ গোসাঈল ডাঙ্গা মন্দিরের পাশে যাবো।
মীরন একটু ভেবে নিয়ে রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো,
– এই তুমিই কি উনাদের রিক্সাওয়ালা?
– রিক্সাওয়ালা এমন প্রশ্নে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত গলায় জবাব দিল,
– হ্যাঁ, আমিই উনাদের রিক্সাওয়ালা। কিন্তু কেন?
– তুমি একটু আগে মোবাইলে কার সাথে কথা বলেছিলে?
– রিক্সাওয়ালা ইতস্তত করতে করতে বলল,
– আমার ভাইয়ের সাথে।
– তোমার ভাই কোথায় থাকে?
– একটু ভেবে নিয়ে রিক্সাওয়ালা উত্তর করলো,
– সে কলসির দিঘির মোড়ে থাকে।
– উনাদেরকে নিয়ে যাবে আগ্রাবাদ গোসাঈল ডাঙ্গা। অথচ মোবাইলে ওকে বললে তোমার জন্য কলসির দিঘির মোড়ে অপেক্ষা করতে। কিন্তু কেন? গোসাঈল ডাঙ্গা যাবার পথ তো সেদিকে নয়?
-এদিকে তাদের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে জ্যাম সরে গেলে রিক্সাওয়ালা ব্যস্ততা দেখিয়ে উচ্চ গলায় বলল,
-আপনি সরেন। শুধু শুধু এসে আমাদের সময় নষ্ট করছেন।
-এই বলে সে রিক্সা চালিয়ে চলে যেতে লাগলো। মীরন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
-এখন কী করা যায়! রিক্সাওয়ালাকে আঁকিয়ে আবার কোন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ি। আবার ভাবলো, আমার মনে তো কোন অন্যায় নেই। কিসের সমস্যা?”
-এই ভেবে দ্রæত মোটরবাইকটা ঘুরিয়ে রিক্সার পিছু ছুটতে লাগলো। রিক্সাচালক হঠাৎ পিছনে ফিরে মীরনকে দেখতে পেয়ে রিক্সা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মীরন রিক্সার সামনে বাইকটি থামিয়ে মহিলাটির দিকে লক্ষ্য করলো।
মহিলাটি বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। মীরনকে দেখে তার শোক যেন আরো বেড়ে গেলো। মীরন তাকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে বলল,
– আপনি ভয় পাবেন না। আল্লাহ্ আজ বড় ধরণের বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। আর একটা কথা, আপনার বাচ্চা আমাদের স্কুলে পড়ে, তাই না? এর আগে স্কুলের অভিভাবকদের ভীড়ে আপনাকে আমি একবার দেখেছিলাম।
– আপনি কোন শাখায় আছেন?
– কলেজ শাখায়।
– সেজন্য আপনাকে আগে কখনও দেখিনি।
– ওহ্! হ্যাঁ, আপনার নাকে, কানে, গলার এতো এতো গহনা-ই আজ আপনার জন্য কাল হতো! এখন কোন সমস্যা নেই। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি একটি রিক্সা নিয়ে নিচ্ছি।
মহিলাটি মীরনের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– আজ আপনি না থাকলে আমার সর্বনাশ হয়ে যেতো। সত্যি তো! যানবাহনে চড়ার সময় চোখ-কান খোলা রাখা দরকার। এই আপনাকে কথা দিলাম, আর কখনো গাড়িতে বসে আমি মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করবো না।
আপনার কাছে আর একটা অনুরোধ করছি, দয়া করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবেন, ভাই।
মুহূর্তে মীরনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। মহিলাটির দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনের দুঃখ ঘুচতে চেষ্টা করে। তারপর কাঁদো গলায় বলে উঠলো,
– আ-মা-র বো-ন!
– এমন করছেন কেন?
– এই পৃথিবীতে আমার যে কোন বোন নেই!
– আচ্ছা, আজ থেকে আমিই আপনার বোন।
অল্প সময়ের পরিচয়ে পরষ্পর পরষ্পরের অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো। বোনকে বাসায় পৌঁছে দিতে এক ভাই তার পিছে পিছে ছুটছে।