ফজিলত ও বরকতময় শাবান মাসের করণীয় আমল

47

ফখরুল ইসলাম নোমানী

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
পবিত্র রজব মাস শেষ হওয়ার পর আকাশে-বাতাসে বরকতময় শাবান মাসের আগমন বার্তার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এখন থেকে ধর্মপ্রাণ ও খোদামুখী বান্দারা পবিত্র রমজান মাসে প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
পবিত্র মাহে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের মাঝে হাজির হলো পবিত্র শাবান মাস। সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমজানের আগাম প্রস্তুতির তাগিদ ও শবেবরাতের উপহার নিয়ে এলো বরকতময় শাবান মাস।
হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো শাবান মাস। এ মাস বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের দেড় বছর পর পূর্বতন কিবলা ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস-এর পরিবর্তে মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম তথা খানায়ে কাবা তথা কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই শাবান মাসেই। তাই শাবান মাস একদিকে যেমন মুসলিম স্বাতন্ত্র ও ইসলামি ঐক্যের মাস অন্যদিকে তেমনি কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।
শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.)-ইরশাদ করেছেন রজব আল্লাহর মাস,শাবান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস। শাবান মাসকে রমজান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-বিশেষ দোয়া করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন।
উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.)-বলেছেন নবী করিম (সা.)-কখনো নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম তিনি বিরতি দেবেন না। আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি নফল রোজা রেখেছেন। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এত অধিক হারে নফল রোজা আদায় করতেন না।
নবী করিম (সা.)-হিজরি সালের শাবান মাসের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের বিবেচনায় এ মাসে অধিক হারে নফল ইবাদত-বন্দেগি করতেন। মাহে রমজানের মর্যাদা রক্ষা এবং হক আদায়ের অনুশীলনের জন্য রাসুলূল্লাহ (সা.)- শাবান মাসে বেশি-বেশি রোজা রাখতেন। এ সম্পর্কে হযরত আনাস (রা.)-বলেছেন- নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো আপনার কাছে মাহে রমজানের পর কোন্ মাসের রোজা উত্তম? তিনি বললেন রমজান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোজা উত্তম। হযরত আয়েশা (রা.)-থেকে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় মাসের একটি হলো শাবান। এ মাসে নফল রোজা আদায় করেই তিনি মাহে রমজানের রোজা পালন করতেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়া বেশি বেশি পড়তেন,আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগ না রমাদান। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন ; রমজান আমাদের নসিব করুন।
মানব জীবনের সব কালিমা দূর করার বিশেষত্ব নিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাস রমজানুল মোবারক আসে শাবান মাসের সমাপ্তির পরই। তাই এ গুরুত্ববহ মাস সারাবিশ্বের মুসলমানদের সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। তাই আসন্ন মাহে রমজানের মূল সিয়াম শুরু করার আগে শাবান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কিছু নফল রোজা রাখা দরকার, যাতে করে মাহে রমজানের রোজা পালন সহজ হয় এবং লক্ষ্যও ঠিকমতো অর্জিত হয়। যারা শাবান মাসে নফল রোজা রাখতে চান তাদের মধ্যভাগেই শেষ করে ফেলা উচিত। শাবান মাসের অর্ধেকের পর বেশি রোজা আর না রাখাই ভালো। মাহে রমজানের প্রস্তুতিকল্পে ইসলামে শাবান মাসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়।
শাবান মাসের বিশেষ আমল সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো-বেশি বেশি নফল রোজা পালন করা। মাস জুড়ে প্রিয় নবি (সা.)-এর নিয়মিত আমল প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা। এছাড়া শুক্রবারসহ এমাসেও আইয়ামে বিজের রোজা অর্থাৎ চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল রোজা পালন করা। রোজা রাখার পাশাপাশি এ মাস জুড়ে নফল নামাজ বেশি বেশি আদায় করা। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশ্ত-দোহা, জাওয়াল, আওয়াবিন, তাহিয়াতুল মসজিদ, দুখুলুল মসজিদ ইত্যাদি নামাজের ব্যাপারে যতœবান হওয়া খুবই জরুরি। আর সব সময় প্রিয় নবি করিম (সা.)-এর শেখানো দোয়াটি পড়া আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য।
হযরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে শাবান মাসে অন্যান্য মাস অপেক্ষা বেশি নফল রোজা রাখতে দেখি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এ মাস অনেকেই খেয়াল করেনা। এটি এমন একটি মাস যে মাসে মানুষের সব কর্মকাÐ আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাই আমি চাই এমন সময়ে আমার কর্মকান্ডের খতিয়ান আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করা হোক যখন আমি রোজা অবস্থায় রয়েছি। নবী করিম (সা.) বলেছেন যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের দিকে মনোযোগ দেন এবং মুমিনবান্দাদের ক্ষমা করেন আর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন (যতক্ষণ না তারা তওবা করে সুপথে ফিরে আসে)।
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেছেন আল্লাহতাআলা মধ্য শাবানের রজনীতে তার সৃষ্টির (বান্দাদের) প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন তবে তারা ব্যতীত যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে এবং অপরকে ক্ষতি সাধনের বাসনা পোষণ করে।
শাবান মাসে শবে বরাত নামে বিশেষ একটি রজনী আছে যে রজনীতে বান্দার সারা বছরের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং আগামী এক বছরের জন্য বান্দার হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত ইত্যাদির নতুন বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যে কারণে শাবান মাসকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ মাসে মুসলমানদের আমল-আখলাক যেন সুন্দর হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.) সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
শাবান মাসে ভারসাম্যপূর্ণ নেক আমলের তাগিদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আমল করবে, কেননা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল তা-ই যা সর্বদা পালন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায় গোটা শাবানে নফল রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও বিশেষভাবে আমল করার উৎসাহ দিতেন। তাই বলা হয় রজব মাসে শস্য বপন করা হয়, শাবান মাসে ফসল কাটা হয় এবং রমজান মাসে ফসল কর্তন করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে শাবান মাসের মর্যাদা এতই বেশি যে যখন তিনি এ মাসে উপনীত হতেন তখন মাহে রমজানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে অধিক হারে এই বলে প্রার্থনা করতেন হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।
মহানবী (সা.)-এর এ দোয়ার মাধ্যমে সবার কাছে শাবান মাসের ফজিলত প্রতীয়মান হয়। শাবান মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির আজকার,তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, শাবান মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।
পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি, হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। আল্লাহপাক আমাদের এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ শাবান মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি,আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়াআসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও মধ্য শাবানের রজনীতে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। রজব ও শাবান মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদতে মশগুল থেকে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন !

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট