ফজলে হাসান আবেদ

2

স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কেসিএমজি, একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। সামাজিক উন্নয়নে তাঁর অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পদক, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার এবং গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের নোবেল বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার লাভ করেছেন।
২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের ‘বিশ্বের ৫০ সেরা নেতার তালিকা’য় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। অশোকা তাঁকে বৈশ্বিক সেরাদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তিনি স্বনামধন্য গেøাবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল অন্ট্রপ্রনোরশিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারিদ্র বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সবচেয়ে সম্মানিত অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জের নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করে। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডের রাজা তাঁকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি অসংখ্য সম্মানসূচক ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন, তন্মধ্যে রয়েছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স (২০০৭), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯) ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব লজ (২০১৪)।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন ভূস্বামী। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার। আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সাথে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডের গøাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৮ সালে গøাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে পরবর্তী কালে তিনি ১৯৬২ সালে লন্ডনের চাটার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টসে চার বছরের পেশাদার কোর্স সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াকালীন ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান আমেরিকা। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এখানে চাকরিকালীন ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। এ সময়ে তিনি ‘হেলপ’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে মনপুরা দ্বীপে গিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের লক্ষ্যে অ্যাকশন বাংলাদেশ এবং হেলপ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সবহারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কল্পে ‘ইধহমষধফবংয জবযধনরষরঃধঃরড়হ অংংরংঃধহপব ঈড়সসরঃঃবব’ বা সংক্ষেপে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধের পর সিলেটের শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি শাল্লায় উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭৩ সালে সাময়িক ত্রাণকার্যক্রমের গÐি পেরিয়ে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন ‘ইজঅঈ’-এই শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেটি হল ‘ইধহমষধফবংয জঁৎধষ অফাধহপবসবহঃ ঈড়সসরঃঃবব’। বর্তমানে ব্যাখ্যামূলক কোনো শব্দসমষ্টির অপেক্ষা না রেখে এই সংস্থা শুধুই ‘ইজঅঈ’ নামে পরিচিত। কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ, এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হল। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন, এবং আবেদ ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে ৬৫ বছর বয়সে নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ তাকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করে। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত¡াবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
প্রভাব, উদ্ভাবনশীলতা, টেকসই সমাধান এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা এনজিও অ্যাডভাইজার ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ব্র্যাককে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন পদ থেকে অব্যহতি নেন এবং চেয়ার এমেরিটাস পদ গ্রহণ করেন।
পুরস্কার * র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, সামাজিক নেতৃত্বের জন্য (১৯৮০)। * ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) * এ্যালান শন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০) * ইউনিসেফ মরিস পেট পুরস্কার (১৯৯২) * সুইডেনের ওলফ পাম পুরস্কার (২০০১)। ‘দারিদ্র বিমোচন ও দরিদ্র মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য’। * শোয়াব ফাউন্ডেশন ‘সামাজিক উদ্যোক্তা’ পুরস্কার (২০০২) * গেøইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩) * জাতীয় আইসিএবি (২০০৪) * জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুব-উল-হক পুরস্কার (২০০৪), সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য। * গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার (২০০৪) * হেনরি আর. ক্রাভিস পুরস্কার (২০০৭) * প্রথম ক্লিনটন গেøাবাল সিটিজেন পুরস্কার (২০০৭) * পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (২০০৭) * ডেভিড রকফেলার পুরস্কার (২০০৮) * দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ ভূমিকার জন্য ব্রিটেন কর্তৃক ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘নাইটহুডে’ ভূষিত। * এন্ট্রাপ্রেনিওর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড পুরস্কার (২০০৯) * ওয়াইজ পুরস্কার (২০১১) * সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ওপেন সোসাইটি পুরস্কার (২০১৩) * লিও তলস্তয় আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক (২০১৪) * বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (২০১৫) * ইয়াইদান পুরস্কার ( নেদারল্যান্ড, ২০১৯)
শ্বাসকষ্ট ও শারীরিক দুর্বলতাজনিত কারণে ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত অবস্থায় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার রাত ৮ টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সূত্র : উইকিপিডিয়া