প্লাস্টিক বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন

63

জলাবদ্ধতা নিরসনে অতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন মন্তব্য করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আমি যেখানেই সভা-সমাবেশ করি, যেখানেই মানুষের সাথে কথা বলি, সেখানেই সবাইকে সচেতন হওয়ার আহŸান করি। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করি, সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। তাদের সচেতনতা ছাড়া এ শহরকে আমি একা সুন্দর করতে পারব না। একজন নাগরিক যদি সচেতন হন, তাহলে দায়িত্বশীলরাও দায়িত্বে ফাঁকি দিতে পারেন না। একই সাথে নাগরিক সেবাও নিশ্চিত হবে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হয়। আমাদের দেশেও হচ্ছে। তবে প্রার্থক্য হলো ওখানে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলেন নাগরিকরা। আর আমাদের দেশের মানুষ রাস্তায়, নালা ও খালে ফেলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ডাস্টবিনে ময়লা ফেলা যেন তাদের জন্য শাস্তিস্বরূপ! আমরা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সচেতন না হই আর যত্রতত্র প্লাস্টিক বা ময়লা ফেলি, তাহলে এ শহরকে কখনও পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব না। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবার প্রতি আহŸান থাকবে, অতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করি এবং ব্যবহৃত প্লাস্টিক নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি। সবাইকে বলতে চাই, আপনারা যদি সচেতনতার সাথে সহযোগিতা করেন, তাহলে আপনাদের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার সিটি কর্পোরেশনের। তখন যদি আমি ব্যর্থ হই, তাহলে সব ধরনের সমালোচনাকে আমি প্রতিদান হিসেবে গ্রহণ করবো।
তিনি আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামকে সবুজ ও পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে নগরবাসীর সহযোগিতা ছাড়া তা অসম্ভব।
সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য শুরু থেকে লিফলেট বিতরণ করে আসছি। মাইকিং করিয়েছি পুরো শহরজুড়ে। এখন ৪১ ওয়ার্ডে নগরবাসীর সাথে নিজে মুখোমুখি হবো। তাদের সাথে সামনা-সামনি কথা বলবো। তাদের সমস্যা-অভিযোগ-অনুযোগের সাথে কথা শুনতে পারবো।

প্রতিক্রিয়া

চাহিদা থাকায়
পলিথিন-প্লাস্টিক
উৎপাদন বাড়ছে

আজাদুর রহমান মল্লিক
পরিচালক,
পরিবেশ অধিদপ্তর (মহানগর)

জলাবদ্ধতা নিরসনে প্লাস্টিক বর্জ্যরে আগ্রাসন বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মহানগর) আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, প্লাস্টিক জলাবদ্ধতা নিরসনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের সুফল নস্যাৎ করে দিবে এ প্লাস্টিক। ভোক্তার অতিমাত্রায় চাহিদার কারণে প্লাস্টিকের উৎপাদনও অনেক বেশি। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি- তা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা আমরা অভিযান পরিচালনা করলেও ভোক্তারা প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান করছে না। যার কারণে প্রতিদিন পলিথিন-প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়ছে।
এক্ষেত্রে আমি মনে করি, ভোক্তাদের পলিথিন-প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করাও অনেক সহজ হয়ে উঠবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও এনজিওকে সম্মিলিতভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। এতে ভোক্তারা সচেতন হবেন এবং প্লাস্টিক বর্জন করবেন এবং প্লাস্টিক আর নগরকে গ্রাস করতে পারবে না। অন্যথায় বন্দরনগীরকে বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

পলিথিন বন্ধে
পরিবেশ অধিদপ্তর
কী করছে

এস এম নাজের হোসাইন
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কেন্দ্রীয় কমিটি, ক্যাব

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ খাল ভরাট হওয়া আর ভরাট হওয়ার অস্ত্র হচ্ছে খাল-নদীতে অতিমাত্রায় প্লাস্টিক বর্জ্য জমা। এ প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু নিজেরা জমে না, অন্যসব বর্জ্যকেও আটকে রাখে। ফলে সহজে খাল-নালা ভরাট হয়ে যায়। এগুলো কীভাবে জমছে? সেই প্রশ্নের উত্তরে আসবে আমাদেন নাগরিকদের অসচেতনতা। তারা প্লাস্টিক ব্যবহার করে যত্রতত্র ফেলছেন। আবার বর্জ্য সংগ্রহকারী সিটি কর্পোরেশনেরও রয়েছে গাফিলতি। ডোর টু ডোর কার্যক্রমে প্রশংসা নিয়ে শুরু হয়েছে কিন্তু শক্তভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না। তাই এখনও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় টাকা দিয়ে বাসার ময়লা ফেলতে হয়। এমনকি বস্তি এলাকাতেও একই অবস্থা। তাই ওখানে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মকর্তাদের শক্ত মনিটরিং করতে হবে।
আবার নিষিদ্ধ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন বন্ধ করার দায়িত্বে রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তারা কী করছে? সারা বছরে একটা-দুটো লোক দেখানো অভিযান দিয়ে তো প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাদের আরও অনেক দায়িত্বশীল হতে হবে। ভোক্তার ওপর চাপ দিয়ে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দায়িত্বশীলদের সমস্যা হচ্ছে- দায় কারো ওপর তুলে দিতে পারলেই বাঁচা গেল। চেয়ারে বসেও দায়িত্ব পালন করতে চাই না। প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। আবার ভোক্তাদের প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরৎসাহিত করতে হবে।
তিনি বেলন, আমরা আগে দেখতাম, মুদির দোকান বা কাঁচা বাজারে কাগজের টোঙা ব্যবহার করা হত। এখন সেসব বিলুপ্তির পথে। পলিথিন ছাড়া তো কথা নেই। এ জায়গা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। অন্যথায় চট্টগ্রামকে বাঁচানো যাবে না।

প্লাস্টিক বন্ধ না
হলে সব অর্জন
বৃথা যাবে

শাহীনুল ইসলাম
প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ
সিডিএ

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, খাল-নদীতে প্লাস্টিক যাওয়া বন্ধ না হলে সব ধরনের অর্জন বৃথা যাবে। জলবদ্ধতা নিরসন হবে, তবে দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
তিনি বলেন, জলবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পানি প্রবাহের সুস্থ ধারা তৈরি করে দেওয়া। খাল পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ বর্জ্যই প্লাস্টিক। এগুলো থেকে খালকে বাঁচানো না গেলে কোনোভাবেই স্থায়ী সমাধানে যাওয়া সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষকে ‘মোটিভেইট’ করতে হবে। সেজন্যই সিডিএ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম থেকে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। মানুষকে বোঝানের চেষ্টা করছি, যাতে মানুষ নির্দিষ্ট স্থানে অন্তত প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলেন। সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তাতে বাসায় বর্জ্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তবে পথে ঘাটে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহার করেই রাস্তায় ফেলছে বা পাশের নালাটিতে। এ জন্য সিটি কর্পোরেশন চাইলে রঙিন ডাস্টবিন বসাতে পারে। তাহলে মানুষ প্লাস্টিক ফেলতে গেলেই ডাস্টবিন দেখবে।
তিনি বলেন, সর্বোপরি আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। এছাড়া নতুন প্রজন্ম যারা এখন স্কুল কলেজে পড়ছে, তাদের সচেতন করা তোলা যায়। যেমন, অনেক দেশের সভ্য শহরে বাসার ময়লা জমা দিলে টিফিন দেয়। অর্থাৎ বর্জ্যরে বিনিময়ে টিফিন। হতে পারে বাসার প্লাস্টিক জমিয়ে জমা দিলে টাকা পাওয়া যাবে। এ বিষয়গুলো সহজলভ্য করা হলে অনেক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি।

‘ওয়ানটাইম’
বর্জন দিয়েই
শুরু হোক

রোমা দাশ
সহকারী পরিচালক
আমেরিকান কর্নার

আমেরিকান কর্নারের সহকারী পরিচালক পরিবেশকর্মী রোমা দাশ পূর্বদেশকে বলেন, শুধু জলাবদ্ধতা নয়, এ শহরকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলছে প্লাস্টিকের অতিমাত্রায় ব্যবহার। এতে খাল-নালা ভরাট ও জলাবদ্ধতা হচ্ছে। নদী-মাটি দূষণ ও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। এখনও প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব নগরবাসী দেখতে শুরু করেছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ না হলে ভয়াবহ হবে পরিণতি। তাই এ নগরের বাসিন্দা হিসেবে সবার যেমন নাগরিক সেবা পাওনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু দায়িত্বও।
নিজেদের বাঁচাতে অন্তত প্লাস্টিক বর্জন করা উচিত। এটা আমাদের জীবনে এমনভাবে মিশেছে, সহজে বর্জন করা কঠিন। তবে আমরা শুরু করতে পারি ‘ওয়ানটাইম’ পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যবহার বর্জন করার মাধ্যমে। যেমন বাজারে গেলে প্রতিটি আইটেমের জন্য একটি করে পলিথিন দেওয়া হয়। এখন থেকে একটি ব্যাগ নিলে এর সমাধান হয়। আবার ‘ওয়ানটাইম’ গøাস, প্লেট ও জুস খাওয়ার স্ট্রয়ের ব্যবহার সহজেই বর্জন করা যায়। কেননা এগুলো অপরিহার্য না। আবার ইদানিং বেড়েছে প্লাস্টিক ফোমের ব্যবহার। বিরানীর প্যাকেট বা মাছের বাজারজাতে এসব বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো প্লাস্টিকের চেয়ে ভয়ঙ্কর। হাজার বছরেও গলে না। তাই এসব ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এছাড়া ভোক্তা যদি নিজেদের বদলে ফেলেন, তাহলে অনেক সহজ হবে। এভাবে যদি অন্তত ৬০ ভাগ নগরবাসী দায়িত্বশীল হন, তাহলে চট্টগ্রাম হাজার বছর এগিয়ে যাবে। সরকারের উন্নয়নের টাকাগুলো নষ্ট হবে না। আমরা পাবো নিরাপদ ও পরচ্ছিন্ন শহর।