প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে

24

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দেশের জন্য এক অদ্ভুত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এই দেশের মানুষের বিদ্যুৎখাতে এই সমস্যাকে, সমস্যা হিসেবে ভাবতে অনেক সময় লেগেছে। কারণ বাংলাদেশে ছিল সে ব্রিটিশ আমল থেকে ঘাটতির দেশ, দুর্ভিক্ষের দেশ ও অভাবের দেশ। কাজেই যে কোন প্রয়োজনীয় জিনিসের উৎপাদন আমরা মঙ্গলজনক মনে করি। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমাদের উৎসাহ অনেক বেশি। কারণ এক সময় ছিল যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদেরকে অন্ধকারে রাত কাটাতে হতো।
কেননা বিদ্যুতের অভাব ভীষণ তীব্র ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে চেষ্টার ত্রূটি করেন নাই, এ অভাব দূর করতে। বর্তমানে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২১০০০ মেগাওয়াটের চাইতেও বেশি। কিন্তু গত ফেব্রূয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের প্রয়োজন হয়েছে ৯০০০ মেগাওয়াটেরও কম, অর্থাৎ আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তার ৫০ শতাংশের প্রয়োজনও আমাদের আপাতত নেই। গত গ্রীষ্মকালে দেখা গেছে, বিদ্যুতের জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় মাত্র ১২০০০ মেগাওয়াটে। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করে না। বিদেশি বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের মতে এইভাবে চললে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে যত বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে তার থেকে ৫৮ শতাংশ বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন হবে। কাজেই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তারা সরকারকে বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সরকার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই।
গত বছরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়,জুনের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ২০১৮, ২০১৯,২০২০ অর্থবছরে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে যথাক্রমে ৯৪৩৭ মেগাওয়াট, ৮৮০৬ এবং ১০২৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চাইতে যথাক্রমে ৫৯ শতাংশ, ৪৬ শতাংশ, ৪৯.৪ শতাংশ বেশি উৎপাদন হয়েছে। অথচ অন্যান্য দেশের মতো প্রতি বছর মাত্র ১০ শতাংশ বেশি উৎপাদন করলে চলত এবং তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হতো।
বি.পি.জি.বির দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী শীত কালে বিদ্যুতের চাহিদা মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ নেমে এসেছে। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর দিনের বেলায় ৭১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে এবং সন্ধ্যায় খরচ হয়েছে ৮৮১৬ মেগাওয়াট। অথচ আমাদের সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ১৯৫৪০ মেগাওয়াট।তাতে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ কত তা আমাদের স্টেট মিনিস্টার নসরুল হামিদের জাতীয় সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছিলেন গত দশ বছরে সরকার ৫২২৬০ কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে, বর্তমানে তা প্রায় ৬০০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলিকে তাদের সাথে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী কোটি কোটি টাকা দিতে হচ্ছে অথচ তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকারের প্রয়োজন হচ্ছে না। ২০১৮ -১৯ সালে সরকারকে শুধু ৯০০০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে। সম্পূর্ণ টাকাটাই শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু এই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কে দায়ী? পরিতাপের বিষয় এই জবাবটা কোথায় এবং কার কাছে পাওয়া যাবে তা জনসাধারণ জানে না। যাঁরা সংসদে সদস্য হয়েছেন তাদের এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয় অকপাটে বিদ্যুৎতের সমস্যার কথা মধ্যে মধ্যে জাতীয় পরিষদে বলেন, তবে এর সমাধান কি বা এ ব্যাপারে তিনি কি কি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা স্পষ্ট করে বলেন না।
২০০৯ সালের দিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫৫০০ মেগাওয়াট, অথচ তখন দেশে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ কোটি। বিদ্যুতের এই স্বল্প উৎপাদনের কারণে মানুষের ভোগান্তির সীমা ছিল না। প্রায় রাত্রের অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বহু কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করতে হতো। নতুন সরকারে এসে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে আরম্ভ করলেন, বর্তমানে তা আমাদের প্রয়োজনের চাইতে দুই-তৃতীয়াংশ বেড়ে গেছে, এর ফলে দেশের অর্থনীতির অবর্ণনীয় এবং অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
সম্প্রতি বি.পি.ডি.বি’র বাৎসরিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪০ শতাংশ বাংলাদেশের প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট। এর অর্থ দাঁড়ায় মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশের জন্য উদ্বৃত্ত হচ্ছে। আজকে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ শতাংশের কম বিদ্যুৎ বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে আর সবটাই উদ্বৃত্ত উৎপাদন। সংবাদমাধ্যমের এক খবরে জানা যায় গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদেরকে অলস বসিয়ে রেখে ভর্তুকি স্বরূপ ৬০০০০ কোটি টাকা সরকারকে শোধ করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থার IEEFA (Institute for energy Economic and Financial Analyst)).
বাংলাদেশের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিতে আরও ১৫৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন করে সর্বমোট ২১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আগের উৎপাদিত বিদ্যুতের সাথে যুক্ত হবে। এই সময়ে মাত্র ৫৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রিটায়ার হবে। এখন প্রশ্ন হলো বিদ্যুতের উৎপাদন এর চাইতে এর ব্যবহার এতো কম কেন? এখানে দুটি কারণের যে কোন একটি হতে পারে। (১)আমাদের যত বিদ্যুতের প্রয়োজন তার চাইতে বেশী হিসাব করে উৎপাদনের পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে। (২) আরেকটি কারণ হতে পারে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের শিল্পায়ন যে হারে হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, ফলে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা কম হচ্ছে। ব্যাপারটা যে কারণেই ঘটুক না কেন, আমাদের অর্থনীতি যে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কাজেই তড়িৎগতিতে আমাদের এই ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মাত্র দুটো প্রশ্ন, বাংলাদেশের যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে, ততটুকু বিদ্যুতের চাহিদা বাংলাদেশের নেই? বিদ্যুৎতের পরিমাণ ভুল করে বেশি পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে? অথবা এখনো আমাদের পরিকল্পনা মতো শিল্প গড়ে উঠে নাই বলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে? যে কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হউক না কেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার ফলে আমাদের অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোন অবস্থাতাতেই এই পরিস্থিতি চলতে দেওয়া যায় না। উপরোল্লিখিত পরিস্থিতির ফলে সরকারকে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। তাতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে গেছে। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ও আমরা দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন। ইউনেস্কো (UNESCO) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা মুখর রয়েছে। তাদের মতে, এই প্রকল্প সুন্দরবনের এত নিকটে যে এই প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে সুন্দরবনকে কোন অবস্থায় রক্ষা করার প্রশ্নই আসে না।
সবচাইতে উদ্বেগের বিষয় হলো বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি টেন্ডারের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সহিত গড়ে তোলা হয় নাই। অভিজ্ঞ মহলের মতে এইসব প্রকল্পে সরকার ঘোষিত ভর্তুকি লাভের জন্য অতিরিক্ত ক্ষমতা দেখানো হয়েছে। মোটামুটি এই খাতটিতে পুঁজি বিনিয়োগ একটি অস্বাভাবিক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।এই খাতে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার কারণে (যা অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত)। এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দেশের অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। কাজেই বিদ্যুৎ খাতকে বিরাজনীতিকরণ বা রাজনীতি মুক্ত করার কোন বিকল্প নেই। আপাতত আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তারপরও অতিদ্রুত এই বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে এই ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করে আমাদের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা উচিত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন গতবছরের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর এক সমীক্ষায় দেখানো হয়, জুনের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ অর্থবছরে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে যথাক্রমে ৯৪৩৭ মেগাওয়াট,৮৮০৬ এবং ১০২১৬ মেগাওয়াট।
লেখক: কলামিস্ট