প্রয়াণ দিবস আজ মাস্টার নজির আহমদ অসাধারণ মানুষ ছিলেন

30

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

 

আজ দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ও সমাজ সংস্কারক মাস্টার নজির আহমদের প্রয়াণ দিবস। ২০১৪ সালের এদিন পূর্বদেশ-এর সকল সাংবাদিক ও কর্মী এবং বাঁশখালীর আপামর জনসাধারণকে শোকসাগরে ভাসিয়ে তিনি অমৃতলোকে পাড়ি দেন। তাঁর পরিবারের সকল সদস্য, বাঁশখালীবাসী ও পূর্বদেশ কর্মীদের জন্য আজকের দিনটি গভীর দুঃখ ও বেদনার দিন।
মাস্টার নজির আহমদ বাঁশখালীর নাপোড়া গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মানব জন্মে ভেদ থাকে না। সব মানব শিশুর জন্ম ব্যতিক্রমহীনভাবে অভিন্ন; বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ মানুষে পার্থক্য সূচিত হতে থাকে। একজন মানুষ আরেকজন থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। শুধু যে গড়নে হয়, তা নয়। মন ও মননেও পৃথক হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ব্যৎপ্রধান রচিত হয় কর্মে। সেজন্য বলা হয়-‘জন্ম হউক যথা তথা কর্ম হউক ভাল।’ কর্মগুণে সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে ওঠে।
মাস্টার নজির আহমদ একজন সাধারণ মানুষই ছিলেন। অনেক শিক্ষকের মতো একজন শিক্ষক। কিন্তু তিনি অসাধারণ হয়ে উঠলেন তখন, যখন তিনি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে থাকলেন। শিক্ষক হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন শিক্ষকও হয়তো দু’একজন পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি সংবাদপত্রও প্রকাশ করেছেন এমন কোন শিক্ষক কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানেই মাস্টার নজির আহমদ অসাধারণ মানুষ এবং শিক্ষকদের মধ্যে সম্মানজনক ব্যতিক্রম।
মাস্টার নজির আহমদ যেখানে শিক্ষক হয়েছিলেন, সেখানে সেকালে খুব মানুষই শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করতেন। যারা চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর, যারা স্বপ্নবাজ, যারা সমাজকে আলোকিত করার কথা ভাবতেন, তেমন লোকগুলোই শিক্ষকতার পেশা অবলম্বন করতেন। আর এসব শিক্ষকের জীবন হতো দুঃখের। অর্থকষ্ট, সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো তাদের। যাদের পেটে দিতে গেলে পিঠে থাকতো না, পিঠে দিলে পেটে পড়তো না-কখনো আধপেটা, কখনো ঠায় উপোস দিয়ে দিবসরজনী পার করে দিতেন মুখের হাসিটি অমলিন ধরে রেখে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আধময়লা টুটা ফাটা জামা কাপড়ে আবৃত দেহের ওপর শতচ্ছিন্ন ছাতাটি ধরে এই নিরীহ প্রাণীগুলি রাজপথ বা গ্রাম্য মেঠো পথের এক প্রান্ত ধরে গম্ভীর মুখমÐলে নির্বিকার ঔদাসিন্য বজায় রেখে হেঁটে যেতেন অবিচলিত পদক্ষেপে। শিক্ষকের এই চিরায়ত মূর্তি দেখে দেখে বাঙালির জীবনে দিন মাস বছর যুগ কেটে যেতো।
মাস্টার নজির আহমদকে নিয়ে আলোচনা করতে বসলে আমার কেবলই দু’জন মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। দু’জনের একজন বাকলিয়ার কাজেম আলী মাস্টার, তাঁকে চট্টগ্রামের মানুষ ভালোবেসে উপাধি দিয়েছিলো ‘শেখ-এ-চাটগাম’। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা-বর্ষ ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর কাজেম আলী হাইস্কুল আজো সগৌরবে টিকে আছে। তিনি রাজনীতিবিদও ছিলেন। আর একজন এনায়েত বাজারের কলিমউল্লাহ মাস্টারÑতিনি স্বনামধন্য নূর আহমদ চেয়ারম্যানের শিক্ষক। কলিমউল্লাহ মাস্টারের পিতাও ছিলেন শিক্ষক। তাঁর নাম এবাদউল্লাহ পÐিত। পিতা-পুত্রের নামের গৌরব বহন করে এনায়েতবাজারে দুটি স্কুল দাঁড়িয়ে আছে। কলিমউল্লাহ মাস্টারই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপয়িতা। তাঁদের ন্যায় মাস্টার নজির আহমদও একই সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্মাতা। কাজেম আলী মাস্টার ও কলিম উল্লাহ মাস্টারে কথা বুঝলাম। তাঁরা শহরের মানুষ, বড় বড় লোকের সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা, মেশামেশা, কথাবার্তা; এই সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া থেকেই তাঁরা প্রাণিত ও প্রণোদিত হতে পারেন। কিন্তু মাস্টার সাহেব গ্রামের মানুষ। এমনিতেই গ্রাম ও শহরের মধ্যে অনেক পার্থক্য; তদুপরি মাস্টার সাহেব বাস করতেন অজপাড়াগাঁয়, পশ্চাৎপদ বাঁশখালী থানার মধ্যেও পিছিয়ে পড়া জনপদ নাপোড়ার ভূমিপুত্র। এই মৃত্তিকা থেকে উদ্ভূত হয়ে তিনি জ্ঞানের আলো জ্বালাবার কথা ভাবলেন এবং সেই ভাবনাই তাঁকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রেরণা জোগান। ছাত্র পড়াতে পড়াতে তাঁর মধ্যে একটি আলো জ্বলে উঠেছিলো, সে আলো তিনি ছড়িয়ে দিলেন বাঁশখালীতে স্কুল কলেজ করে; চট্টগ্রামে ছড়িয়ে দিলেন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে।
দেশের প্রতি, চট্টগ্রামের প্রতি, বাঁশখালীর জন্য মাস্টার নজির আহমদের অবদান কি কি তা’ এখন বলার সময় হয়েছে। প্রথমত শত শত ছাত্রকে তিনি মানুষ করেছেন। তাদের অন্তরে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। তাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। ছাত্ররা তাঁর সন্তানের মতো।
দ্বিতীয়ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। তিনি চারটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেনÑযথাক্রমে
১. মাস্টার নজির আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।
২. আম্বিয়া খাতুন মহিলা দাখিল মাদ্রাসা, এই মাদ্রাসাটি বর্তমানে আলিম পর্যায়ে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে। উল্লেখ্য যে, আম্বিয়া খাতুন তাঁর সহধর্মিণী।
৩. এতিম শিশুদের শিক্ষা ও প্রতিপালনের জন্য বাড়ির পাশে তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন জোবেদা খাতুন এতিমখানা ও হেফ্জখানা।
৪. মাস্টার নজির আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
৫. তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ‘মাস্টার নজির আহমদ ট্রাস্ট’। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাস্টার নজির আহমদের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নকরণ এবং উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ বাঁশখালীর আর্ত-সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
এছাড়া সমগ্র দক্ষিণ বাঁশখালীর প্রায় সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় তিনি অনুদান প্রদান করতেন, যার ধারাবাহিকতায় এখন বজায় রেখেছেন তাঁর সন্তানরা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজটি বর্তমানে স্নাতক স্তরে উপনীত হয়েছে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মাস্টার নজির আহমদ ডিগ্রি কলেজ গৌরবজনক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। একই সাথে বাঁশখালী উপজেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
সমাজের উন্নয়নে, জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তিনি নীরবে অকাতরে দান করেছেন। তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে কেউ শূন্যহস্তে প্রত্যবর্তন করেছেন, এমন কথা কেউ কখনো শোনে নি, দেখেনি, বলেনি। টাকা-পয়সার অভাবে কারো পড়াশোনা আটকে গেলে; এমনিভাবে কারো মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, নিকটাত্মীয় কিংবা নিজের কঠিন রোগব্যাধির চিকিৎসা অর্থাভাবে ব্যাহত হলে; কিংবা কারো ঘরে চাল বাড়ন্ত হলে, কিংবা অর্থাভাবে ভাত-কাপড়ের অভাব হলে, কোনোভাবে তা মাস্টার সাহেবের গোচরীভূত হলে তিনি টাকা-পয়সা, ভাত-কাপড় দিয়ে তাদের চিকিৎসা ও অন্ন সংস্থান করেছেন। এই সূত্রে শরণাগত বা সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে তিনি ‘দানবীর’ বা ‘হাতেম তাই’। একটি কলেজ, একটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা ও হেফজখানা ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও তিনি প্রতি বছর দক্ষিণ বাঁশখালীর বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বই কিনে দিয়ে তাদের বিদ্যার্জনে সাহায্য করতেন। এছাড়া সমগ্র বাঁশখালীর প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় দান-অনুদান দিয়ে তিনি বাঁশখালীতে শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার বিদ্যোৎসাহিতা কিংবদন্তীর পর্যায়ে উপনীত হয়। তাঁকে মামুলি শিক্ষনুরাগী বললে কমই বলা হয়।
২০১২ সালে তাঁর আর এক সন্তানের জন্ম হলো, সেটি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা।
মাস্টার নজির আহমদের সাত পুত্র সন্তান ও তিন কন্যা রয়েছে। তাঁর পুত্র সন্তানরা হচ্ছেন- আলহাজ শফিকুর রহমান, আলহাজ মফিজুর রহমান, আলহাজ মোস্তাফিজুর রহমান সিআইপি, আলহাজ আজিজুর রহমান, আলহাজ মুজিবুর রহমান সিআইপি, আলহাজ মাহফুজুর রহমান, আলহাজ তারেকুর রহমান। তাঁর তিনটি কন্যাসন্তান রয়েছে। কন্যা সন্তানরা হলেন-মোতাহেরা বেগম, রহিমা বেগম, মরিয়ম বেগম।
মরহুমের সন্তানদের মাঝে একটি চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। বলা যায়, এমন চমৎকার বোঝাপড়া ও সমঝোতা যৌথ পরিবারের ভাঙ্গনের এ যুগে একান্তই দুর্লভ। তারা এক ছাদের নিচে থাকেন, একই চুলায় সকলের রান্না হয় এবং একই টেবিলে বসে সবাই আহার করেন। এমন পারিবারিক সংহতি ও সুস্থিতি সত্যিই বিস্ময়কর। এমন একটি আদর্শ পরিবার উপহার দিয়ে নজির আহমদ মাস্টার দেশকে পারিবারিক আদর্শের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন। দেশ ও জাতির প্রতি এটাও তার আরেক বড় অবদান।
৮৬ বছরের এক পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে মাস্টার নজির আহমদ অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর জীবনের ভরা কলস কানায় কানায় ভরে উপচে পড়েছিলো পাকা ফসলে। সমস্ত প্রাপ্তি তার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছিলো এবং ঐশ্বর্য্যে ভরিয়ে দিয়েছিলো। ব্যক্তি মানবের সীমায়িত জীবনের আধারে যখন সকল সদগুণ ও সুকুমার বৃত্তির সমাবেশ ঘটে, তখন তা পূর্ণ প্রস্ফুটিত পুষ্পসম পাপড়ি ছড়িয়ে চতুর্দিক সুরভিত করে তোলে, তখন সে মানুষকে বলতে হয় সম্পূর্ণ মানুষ। নজির আহমদ মাস্টার এমনি এক সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। এ মহান জ্ঞানসাধকের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক