প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ইসরাইলের নীতিই বাস্তবায়িত করছেন

86


সম্রাট সাইরাস দি গ্রেট প্রায় ২৫০০ বৎসরেরও আগে বিশাল পার্সীয়ান সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ইরানের শাহ-মোহাম্মদ রেজা পাহলবী ছিলেন সে সা¤্রাজ্যের শেষ সম্রাট। তাঁর উপাধি ছিল শাহেন শাহ (রাজাদের রাজা)। ১৯৭১ সালে ইরানের শাহ্্ পারস্য সাম্রাজ্যের ২৫০০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে ইরানের রাজধানী তেহরানে এক বিশাল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী ‘টাইম’ এই অনুষ্ঠানের উপর একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সে প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে অনুষ্ঠানে তখনকার ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছিল। তখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব চাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান। পাহলবীর পিতাই পারস্য সাম্রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘ইরান’ করেছিলেন। যাই হউক, ১৯৭৮ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে এক গণ-বিপ্লবের মাধ্যমে রেজা পাহলবী এবং তার নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত হন। অবশ্য পতনের কিছুদিন আগেই সম্রাট রেজা পাহলবী প্রধানমন্ত্রীকে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিজে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি দেশ ত্যাগের ১৮ মাস পর মিসরের রাজধানী কায়রোতে ক্যান্সারের চিকিৎসারত অবস্থায় দেহত্যাগ করেন।
১৯৭৯ সালে তেহরানে আমেরিকার দূতাবাসে প্রায় ৫৮ জন কর্মচারী এবং কর্মকর্তাকে ইরানী বিপ্লবের মধ্যমণি আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ক্যাডারেরা অনেকদিন অবরুদ্ধ করে রাখে। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে যে অহিনুকুল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ওবামা যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে ইরানের উপর পরমাণু অস্ত্র তৈরীর বিরুদ্ধে এমন চাপ সৃষ্টি করেছিলেন, ইরান অনেকটা বাধ্য হয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই ভিয়েনায় ইরানের সাথে বিশ্বের ছয়টি দেশের সাথে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈয়ার না করার প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ইরানের সাথে যে ছয় জাতির সমঝোতা হয় তারা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মান। তখনকার বিশ্বের সেরা কূটনীতিকরা বিশ্ব শান্তির জন্য এই চুক্তির গুরুত্বের কথা স্বীকার করেছিলেন এবং চুক্তির জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা সহ এই চুক্তির ব্যাপারে অন্য যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁদের সবার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এই চুক্তির পর আমেরিকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তার “অসবৎরপধ ঋরৎংঃ” নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির পর থেকে শুধু ইরান নয়, আমেরিকার সমস্ত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় যা দিনের পর দিন তীব্র এবং সাথে সাথে তীক্ত হচ্ছে। এদিকে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির দিন থেকেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে এর তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন। এমনকি এব্যাপার নিয়ে তখন নেতানিয়াহুর সাথে প্রেসিডেন্ট ওবামার সম্পর্কের পর্যন্ত অবনতি ঘটে। পরে এই চুক্তি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে। কাজেই এই চুক্তিটি বিশ্বের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক চুক্তিতে পরিণত হয়।
আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পরই তিনি একটির পর একটি এমন সিদ্ধান্ত নিতে আরম্ভ করলেন, তাতে শুধু বর্হিবিশ্বের দেশগুলি নয়, আমেরিকার রাজনৈতিক মহল এবং কূটনৈতিক মহলও কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ে। প্রথমেই বিশ্বের সবদেশের সাথে আমেরিকারও স্বাক্ষরিত ‘বিশ্ব জলবায়ু চুক্তি’ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে যায়। তারপর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত ছয় জাতির পারমাণবিক চুক্তির তীব্র সমালোচনা আরম্ভ করেন। অবশেষে সত্যি সত্যিই ২০১৮ সালের ৮ই মে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়া হলো। বিশ্বের সেরা ছয়টি দেশ মিলে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটা শ্রেষ্ঠ অর্জনকে শুধু নেতানিয়াহুর প্ররোচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অকার্যকর করে দিলেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে উত্তপ্ত সম্পর্ক চলছে। ইতিমধ্যেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন বিমান ভূপাতিত করেছে। এর উত্তরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে সামরিক আক্রমণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি কমান্ডকে হুকুম দিয়েছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সে হুকুম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বর্তমানে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অঞ্চলের সর্বদিক দিয়ে সবচাইতে শক্তিশালী দেশ। বর্তমান ইরান সরকার একটি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের ক্ষমতা দখল করেছিল এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় ঠিকে আছে। এই সরকারের পিছনে লক্ষ লক্ষ সুসংগঠিত রাজনৈতিক কর্মী বাহিনী রয়েছে। এই পর্যন্ত আমেরিকা সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে যুদ্ধে জড়িত হয়েছে, সে সব যুদ্ধে ট্রিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, বৎসরের পর বসর আমেরিকার সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যের জীবন দিয়েও কোথাও আমেরিকার পক্ষে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন সম্ভব হয় নাই। উপরোল্লিখিত দেশগুলির চাইতে ইরান অনেক বেশী শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইরানী বিপ্লবী আদর্শের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। বর্তমানে ট্যাংক, রকেট, কামান, দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইরান নিজের দেশেই তৈয়ার করে। ইতিমধ্যে রাশিয়া এবং চীনের সাথেও ইরানের পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে, নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশূণ্যে ইরান কৃত্রিম উপগৃহ পাঠিয়েছে। আসলে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেওয়া ইরানের উপর বক্তব্যগুলি এত বেশী এলোমেলো যে তার লক্ষ্য কি তাই বুঝতে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা এই কথায় একমত, আমেরিকার পর-রাষ্ট্র সেত্রেটারী পম্পিও ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বল্টন এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর একমাত্র উদ্দেশ্য যুদ্ধের মাধ্যমে বর্তমান ইরানের শাসক দলকে উৎখাত করা। কিন্তু ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হলো পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি পুনঃবার পর্যালোচনা এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ইরানের সাথে যুদ্ধ পরিহার করা। এই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কাবু করার জন্য যেসব কৌশল গ্রহণ করেছে তাতে ইরান আরও বেশী আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরানের যে কোন দুর্যোগে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং চীন উভয় পরাশক্তি যেভাবে সাহায্য এবং সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেবে তা এককালে কল্পনাও করা যেতনা। আমেরিকা যদি ইরানকে ৯০ দশকের ইরাক ভাবে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে, বলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র গত দুই দশক ধরে ইরানকে কোণঠাসা করতে গিয়ে অস্ত্রের দিক দিয়ে ইরান নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে করতে বাধ্য হয়েছে। ইরাকে সামরিক অভিযান এবং পরবর্তী সময়ে ইরাকের প্রতি আমেরিকার আচরণের ফলে ইরাক আজ ইরানের পরম বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অথচ সাদ্দাম হোসেনের সময়ে ইরান এবং ইরাকের মধ্যে আমেরিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের তার বন্ধুরাষ্ট্রগুলির প্ররোচনায় প্রায় ৮ বৎসরব্যাপী যুদ্ধ চলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরাক যুদ্ধের খেসারত এখনও দিয়ে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত হিসাব করলে ইরাক, আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জিডিপির আকার হলো ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার। কাজেই কারও বুঝতে অসুবিধা হবেনা, ৭ ট্রিলিয়ন ডলার যুদ্ধে খরচ করা আমেরিকার জন্য ভীষন ব্যয়বহুল যুদ্ধ ছিল। আজকে সারা মধ্যপ্রাচ্যে যে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থী ধারার রাজনীতির উদ্ভব হয়েছে তার দায় দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। এই ৭ ট্রিলিয়ন ডলার যদি বিশ্বের দারিদ্রতা দূরীকরণে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করত তাহলে বিশ্বের সম্পূর্ণ দারিদ্রতার অবসান হতো। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে সম্মানের আসনে আসীন হত। অথচ, সমস্ত মধ্য প্রাচ্যে চরমপন্থী সৃষ্টির পিছনে আমেরিকার অবদানই সব চাইতে বেশী। এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কাউকে দায়ী করার কোন সুযোগই নেই। এবার যদি ইরানের উপর হামলা করা হয় তাতে আমেরিকার কোন রাজনৈতিক বা কোন সামরিক উদ্দেশ্য পূরণ হবে বলে মনে হয়না। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামার চেষ্টার ফলে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে সু-সম্পর্ক সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল তা নস্যাৎ করে দেওয়া ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বারা এব্যাপারে ভাল কিছু অর্জন সম্ভব হয় নাই।
বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি দেশ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করুন এবং সে চুক্তি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দিল। বিশ্বের এই রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি থেকে শুধু ক্ষুদ্র একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্ররোচনায় কোন আলোচনা ছাড়া বেরিয়ে আসলেন তা আমেরিকার জন্য কলংকজনক ঘটনা এবং আমেরিকার সংশ্লিষ্ট প্রেসিডেন্টকে ইতিহাসে এর জন্য অর্বাচীন বালক হিসাবে অবশ্যই লিপিবদ্ধ করবে। ইতিহাস কাকেও ক্ষমা করেনা।

লেখক : কলামিস্ট