প্রায়শ্চিত্ত

104

গত সংখ্যা পর

জীবনের প্রথম হাজতবাস। পরদিন বিচারকের ভরা মজলিসে হাজিরা দিতে যাবেন রবিউল হোসাইন সাহেব। তার আগে হাজতে মশাদের বিশ্রীরকম অভ্যর্থনায় তিনি তিতিবিরক্ত। এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে আসেনি। না বড় মেয়ে, না ছোট মেয়ে, বা তাদের স্বামীদের কেউ। ছেলে তো নেই তাঁর। পত্নীবিয়োগ হয়েছে তাও সাত বছর হয়ে গেল প্রায়। কেউ আসবে বলেও মনে হয় না। কোন মুখে আসবে তারা? তিনি যে চুনকালি মেখে দিয়েছেন। পথ বন্ধ করে রেখেছেন।
ছোট্ট ভুল, কিন্তু কত বিরাট মাশুল! রবিউল হোসাইন সাহেব তাজ্জব বনে যান এই ভেবে যে, এমন অনেক কিছু ঘটে যায় জীবনে যেখানে মানুষের কোন হাত থাকে না। অথচ তাকেই কিনা ভোগ করতে হয় এর ভয়ানক পরিণতি! পোহাতে হয় অসহনীয় দুর্ভোগ। পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কেন এমন হয়, কেন? এই জিজ্ঞাসা তাঁর মনে জাগে বারে বারে হাজার বার। কিন্তু কোন সদুত্তর পান না তিনি। এ এক বিরাট রহস্যই থেকে যায় তাঁর কাছে।
এসব যখন ভাবছেন রবিউল হোসাইন সাহেব তখন জেনেছেন, কেউ একজন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। একটু অবাকই হলেন যেন তিনি। কে হতে পারে? আরও অধিক বিস্মিত হয়ে তিনি দেখেন, সেই মহিলা এসে হাজির যিনি সুহাসিনী, কিন্তু কটুভাষিণী। তিনি ফারজানা, তাঁর বড় মেয়ের ঝগড়াপ্রবণ প্রতিবেশিনী।
‘ কলি যুগের পুরুষরা সব এক’, কোন ভূমিকা ছাড়াই দুই ঠোঁটের ফাঁকে ভূবনভুলানো হাসি ঝুলিয়ে বলতে শুরু করেন ফারজানা,‘ তারা সবাই রূপের পাগল। সুযোগ পেলে ছুঁড়ি বুড়ি কাউকেই ছাড়তে চায় না। ঠিক কিনা বলুন রবিউল সাহেব।’
‘ আমি কিন্তু নির্দোষ মেম।’
‘ জানি। আপনার ঘটনার কথা শুনেছি পরে।’
‘ এবার নিশ্চয়ই অভিযোগ তুলে নেবেন। আমি ছাড়া পাব।’
‘ কেন নয়? অবশ্যই আপনি এখান থেকে বের হয়ে সসম্মানে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু আমার যে একটা শর্ত আছে রবিউল সাহেব।’
‘ কী শর্ত?’
‘ আপনি প্রফেসর মানুষ। রিটায়ার করেছেন। বিপত্নীক। মরুভূমিতে একা থাকেন। কিন্তু শুকিয়ে যাননি বা ক্ষয়ে যাননি এখনও। আমি চাই আপনি পেয়িং গেষ্ট হিসেবে আমার বাসায় থাকবেন। আমার মেয়ে দুটোকে পড়াবেন। খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা দূর হবে। ভাল যত্ন-আত্তিও হবে। আমি নিজে আপনার দেখাশুনা করব। তখন দেখবেন কী হয়। মরা গাঙ্গে আসবে ভরা জোয়ার। চাঙ্গা হবে মন। ফুলে ফুলে আবার কানন হয়ে উঠবে আপনার জীবন।’
‘ এই শর্ত কেন মেম?’
‘ প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই রবিউল সাহেব। প্লীজ।’ শরীরী ভাষা, পোশাকী ভাষা, মুখের ভাষা এক করে এমন একটা কিছু তিনি ফুটিয়ে তুললেন অবয়বে বা এমন কিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইলেন যা যুগ যুগ ধরে সেই অনাদিকাল থেকে চলে আসছে পুরুষ মানুষের বহুল কাংক্ষিত হিসেবে এবং যা হচ্ছে ইবলিশের প্রধান ও মোক্ষম হাতিয়ার মনুষ্য প্রজাতিকে বিপথগামী করার জন্য।
ফারজানার প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারেন না রবিউল হোসাইন সাহেব। প্রথম কথা হল, মহিলা যা চান এক কথায় তা হল অনাচার। এতে তাঁর সায় নেই মোটেই। দ্বিতীয় কথা, কারো বাসা-বাড়িতে পেয়িং গেষ্ট হয়ে থাকার কোন ইচ্ছাই তাঁর নেই। তৃতীয়ত, মেয়েদের মান-সম্মান ও সামাজিক অবস্থান আক্রান্ত হবে প্রচন্ডভাবে। ভয়ানক মনোকষ্টে ভূগবে তারা।
কিন্তু ফারজানা নাছাড়বান্দা। তাঁর কথা হল, হয় আমার প্রস্তাবে রাজী হও, নয় তো মামলার ঝামেলা সামলাও। যুৎসই উপঢৌকন পেলে পুলিশ তাঁর কথামতই কাজ করবে। নিয়ম ভেঙ্গে হাজতবাসের সময় নির্যাতন করবে। আর এ কথা তো সকলেরই জানা আছে যে, বাঘে ছোঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছোঁলে…. ঘায়ের শেষ নেই।

রবিউল হোসাইন সাহেব যেদিন প্রথম এলেন এখানে পেয়িং গেষ্ট হয়ে, সেদিনই আমিনারা বাসা নিয়েছে দশ সহ¯্র গজ দূরে এই পাড়ার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অন্য কোথাও। লাজে ক্ষোভে অপমানে লাল হয়ে আমিনারা যেদিন ছেড়েছে ফ্ল্যাট, সেদিন ফারজানার হাসিটা ছিল দেখার মত। এমন চওড়া হাসি জীবনের প্রথম ছিল সেটি। খুশিতে তিনি ছন্দে ছন্দে উদ্বাহু নৃত্য করেছেন ময়ূরের মতন পেখম মেলে। অন্যদিকে ছোট্ট রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে আগাপাশতলা ডুবে ছিলেন রবিউল হোসাইন সাহেব। আর উন্মাদের মত পান করেছেন আকন্ঠ, শান দিয়েছেন আজন্ম ভোঁতা ক্রোধের ছুরিকায়। তিনি এখন ফারজানার একান্ত অনুগত ও বিশ^স্ত দাস। ফারজানা যা বলেন, তিনি তাই করেন। ওঁকে দেবী জ্ঞান করেন। তবে মাঝে মাঝে তাঁর বিদ্রোহী মন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন ফারজানা ভয় দেখান, মামলার দেহে প্রাণ সঞ্চারিত করবেন তিনি। অচলকে সচল করে সরিয়ে নেবেন আঁচল। এমন ধমকিতে দমে যান প্রফেসর সাহেব। দেবীর দেখানো রাস্তায় পুনরায় পথ চলতে শুরু করেন তিনি। আর ওঁর দেহাঞ্চলে অনল সৃষ্টি হলে দমকল হয়ে তাতে জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে চমৎকার খুশি ফারজানা। তিনিও প্রফেসরের সেবায় ত্রূটি রাখেন না। নিজের হাতে সব করেন। ঘাম ঝরিয়ে তবেই নিবৃত্ত হন।
এসব দেখেশুনে প্রফেসর তো বটেই, আমরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না প্রায়শ্চিত্ত আসলে করছে কে, দীর্ঘ সময় স্বামীসোহাগ থেকে বঞ্চিত কলিযুগের রম্ভা দেবী ফারজানা, নাকি কিশোরী বালিকার সম্ভ্রম লুটের চেষ্টাকারী বলে অভিযুক্ত বিপত্নীক রবিউল হোসাইন সাহেব, নাকি ঘটনার নায়ক প্রতিনায়ক দুজনেই।