প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্র

365

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য শিশুর পরিপূর্ণ জীবন গঠনে একে অপরের পরিপূরক কারণ শিক্ষা গ্রহণের প্রধান শর্ত হচ্ছে রোগমুক্ত সুস্থদেহ, অসুস্থ কোন শিশু যদি ক্লাশে বসে শিখন শেখানো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শিক্ষকের হাজারো চেষ্টা সত্তে¡ও কোনক্রমেই ঐ শিশুর শিখনকল অর্জন করানো সম্ভব হবে না তাই শিক্ষা গ্রহণে উপযুক্তভাবে তৈরি করতে শিশুদের সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা নিঃসন্দেহে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেককে দেখা যায় বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েও স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকায় দুর্বিসহ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য দরকার স্বাস্থ্য শিক্ষা যার জন্য সর্বোত্তম যায়গা হলো একটি বিদ্যালয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বহু এমন বিদ্যালয় আছে যার মধ্যে এই স্বাস্থ্য শিক্ষা চরমভাবে অবহেলিত। ফলে বেশিরভাগ শিশু কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং একই সাথে তাদের বয়স,চাহিদা ও শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণের সামর্থ্যকে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করছে, বিদ্যালয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবক এবং বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। সেকলের সম্মিলিত ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় একটি বিদ্যালয় গড়ে উঠতে পারে সুশিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।
প্রথমেই বিদ্যালয় ভবনের কথাই ধরা যাক, বিদ্যালয় ভবন এমন জায়গায় হওয়া উচিত যা হবে নিরাপদ, কোলাহলমুক্ত, পরিচ্ছন্ন, সমতল খোলামেলা পরিবেশে, যেহেতু একত্রে সকাল থেকে বিকাল একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রচুর ছেলে মেয়ের অবস্থান করতে হয়। তাই বিদ্যালয় ভবনের দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর সবকিছুর দিকে নজর দিতে হবে। বৃষ্টির দিনে ছাদে পানি জমতে না পারে, বৃষ্টির পানি সরাসরি শ্রেণি কক্ষে ঢুকতে না পারে, রোদ সরাসরি শ্রেণি কক্ষে ঢুকতে না পারে বিষয়গুলো ভবন তৈরির সময় খেয়াল রাখতে হবে। কক্ষের আকার আকৃতি শিক্ষার্থীর সংখ্যার আনুপাতিক হারে হওয়া উচিত।
স্টুডেন্ট কাউন্সিল সদস্যদের নেতৃত্ব প্রতিদিন শ্রেণি কক্ষ ঝাড়– দেয়া, দেয়ালের ঝোল পরিষ্কার করা, যার ফলে ধুলাবালি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া সপ্তাহে বৃহস্পতিবার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে পুরো বিদ্যালয় পরিবেশ সুন্দর রাখা যায়।
বিদ্যালয়ে প্রতিদিন শিশুদের যথাসময়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে মাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, পরিষ্কার স্কুল ড্্েরস পরিয়ে, পুষ্টিযুক্ত কিছু খাবার খাওয়ায়ে, বই খাতাপত্র গুছিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। সাথে টিফিন ছুটিতে খাওয়ার জন্য টিফিন বক্সে কিছু খাবার দিয়ে দিতে হবে(গরফ ফধু সবধষ)ফলে তারা অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং পড়ালেখায় মন বসবে। অনেক শিশু মায়ের দেয়া খাবার না এনে দোকানের খোলা খাবার তেলে ভাজা সিংগারা, চমুচা ইত্যাদি কিনে খায়, এই খাবারগুলো কতটা স্বাস্থ্য সম্মত তা প্রশ্নবোধক। তাছাড়া অনেক বিদ্যালয় গেইটে আচার জাতীয় পঁচাবাসি খাবারের পসরা সাজিয়ে দোকান বসে, শিশুরা এইসব দোকান থেকে খাবার খায় ফলে মারাত্মক পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। তাই এইসব দোকান সরাতে হবে। তাছাড়া একটি বিষয় মা বাবাকে অধিক সচেতন হতে হবে শিশু যাতে খালি পায়ে না থাকে এবং খালি পায়ে বিদ্যালয়ে না যায়, তাদের জুতো-সেন্ডেলের ব্যবস্থা করতে হবে কেননা এমন অনেক ছোট জীবাণু, কৃমি থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না সেগুলো পায়ের তালু দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে ফলে শারীরিক অসুস্থতা ডেকে নিয়ে আসে।
শিশুদের কোনভাবেই তাদের মনে রেখাপাত করে এমন কিছু করা বা বলা যাবে না যেমন তাদের বেত্রাঘাত করা, চড়-থাপ্পড় মারা কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে বকাঝকা করা ,যা তাদের দেহমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে,সুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হবে। শিক্ষকগণের অবশ্যই উচিত শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি পরিহার করা। তাছাড়া শিশুরা অনেক সময় একে অপরের সাথে ঝগড়াঝাটি করে মারাতœক জখম করে ফলে স্বাস্থ্য হানি ঘটে এবং দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। শিক্ষকগণের বিষয়টি কঠোরভাবে দেখতে হবে যাতে শিশুরা সকলে যেন মিলে মিশে থাকে।বিদ্যালয়ে প্রতিদিন শ্রেণি পাঠশুরুর পূর্বে সমাবেশ যথানিয়মে করতে হবে, চঞ/ব্যায়াম অবশ্যই থাকতে হবে। আঙ্গুলের ব্যায়াম, হাতের ব্যায়াম, হাটুর ব্যায়াম, ঘাড়ের ব্যায়ামের ফলে শিশুর অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে রক্ত চলাচলের গতি স্বাভাবিক থাকে এবং শিশুর শারীরিক গঠন ও স্বাস্থ্য সমুন্নত থাকে। শুদ্ধাচার, নৈতিকতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, দেশাত্ববোধ সম্পর্কে শিক্ষক সমাবেশে শিশুদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য তুলে ধরবে। সুস্থ থাকার কৌশল নিয়েও শিক্ষক আলোচনা করবে।
ডধংয ইষড়পশ এবং টয়লেটের অবস্থানটা অবশ্যই পরিকল্পিত সুন্দর জায়গায় হতে হবে। বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে, শ্রেণি কক্ষের সামনা সামনি, শ্রেণিকক্ষের দেয়াল সংলগ্ন জায়গায় করা যাবে না। টয়লেটে লাইট, হারপিক, সাবান, মগ, বালতি, টাওয়েল অবশ্যই রাখতে হবে। সেন্ডেল পরে টয়লেট যাওয়া, টয়লেট ব্যবহারের পর বেশি করে পানি ঢালা এবং সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া এইসব নির্দেশনা শিশুদের ভালভাবে দিতে হবে এবং ডধংয ইষড়পশ এর দেয়ালে তা লিখে দিতে হবে। কেননা অপরিচ্ছন্ন টয়লেট দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে যা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া বিদ্যালয়ের গা ঘেষে ব্যক্তি বিশেষের খোলা টয়লেট, প্রস্রাবখানা যার দুর্গন্ধ শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকী স্বরূপ। এই বিষয়ে বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে সচেতনতামূলক আলোচনা করে টয়লেট অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ।
বিদ্যালয় পার্শ্বে গড়ে উঠা পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরী ফার্ম পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর করার অন্যতম প্রধান কারণ তাদের বর্জ্য থেকে মারাত্মক পটুতিময় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পুরো বিদ্যালয় পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর সহ শিখন শেখানো কার্যক্রমে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে শিশুরা বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে উঠে। এই ক্ষেত্রে স্থাপনা মালিকদের সাথে বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট কমিটির আলোচনায় সুফল পাওয়া না গেলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে হবে। অনেক বিদ্যালয়ের মাঠে সাপ্তাহিক হাটবাজার বসে যার কারণে ময়লা আবর্জনার স্তূপ গড়ে উঠে অপরিচ্ছিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা থেকে শিশুর অসুখ বিসুখ হতে থাকে। এ ছাড়া বিদ্যালয় সংলগ্ন দোকানপাট, অনেক মানুষের আনাগোনা, হৈ-চৈ , মেশিনের আওয়াজ এই সব শিশুদের পাঠগ্রহণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে শিশু মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির সম্মুখিন হয়। হাইওয়ের পার্শ্বে অবস্থিত বিদ্যালয়গুলোতে মারাত্মক শব্দ দূষণ ঘটে এবং গাড়ীর কালোধোয়া ও গাড়ীর চাপে মাটির কম্পন সব কিছু মিলিয়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় । এই ক্ষেত্রে বিদ্যালয় স্থানান্তরে স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি এবং কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
ক্ষুদে ডাক্তার টীমের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রোগ্রামগুলো যেমন টীকা খাওয়ানো, কৃমি সপ্তাহ, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানগুলো ভালভাবে সুসম্পন্ন করা হয়। কিন্তু এই ক্ষুদে ডাক্তার টীমের সদস্যগণের পাঠ্যবইয়ের সূচির বাইরে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তেমন কোন জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাই স্থানীয় উদ্যোগে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের সহযোগীতায় তাদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের আওতায় আনা খুবই জরুরী অথবা সপ্তাহে একদিন ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা পালাক্রমে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ক্ষুদে ডাক্তারদের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ঘন্টা ব্যাপী ব্রিফিং কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। ফলশ্রæতিতে ক্ষুদে ডাক্তারের মাধ্যমে সকল শিশুই স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে অনেক উপকৃত হবে।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের শিখন শেখানো কার্যক্রমের পাশাপাশি সহ শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী চালু রাখতে হবে। বিভিন্ন দিবস পালন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শিশু দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস সহ বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ফলে চিত্ত বিনোদনের মাধ্যমে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এর সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে শুধু রোগ এবং জরাকে দূরে রাখা মানেই স্বাস্থ্য নয়, সম্পূর্ণরূপে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক ভাবে ভালো থাকাকে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা হিসেবে ধরা হয়। স্বাস্থ্যকে দেখা হয় গতিশীল, পরিবর্তনশীল এবং দৃশ্যমান বিষয় হিসেবে। পরিশেষে এটাই বলা যায় একটি বিদ্যালয় শুধুমাত্র পড়ালেখার জায়গা নয়, সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কিত জ্ঞানার্জনটাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাই বলা যায়Ñ সুস্থ দেহ সুস্থ মনে, পড়ালেখায় সফলতা আনে।

লেখক : সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।