প্রাণের মেলা বইমেলা ও প্রাসঙ্গিক কথন

21

এমরান চৌধুরী

বইপ্রেমি মানুষ খুব ভালোভাবেই জানেন বইয়ের মতো অকৃত্রিম বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। বন্ধুর সাথে বন্ধুর মতের অমিল হতে পারে, স্বার্থের সংঘাত হতে পারে, টাকাআনাপাই নিয়ে বিরোধ লেগে থাকতে পারে, তারপর ফাইলপত্র নিয়ে কোর্টকাচারিতে দৌড়াতেও হতে পারে কিন্তু বইয়ের সাথে তা কখনও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ কারণে কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, রুটি, মদ, ফুরিয়ে যাবে। প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়। ‘যদি তেমন বই হয়’- কবি ওমর খৈয়াম এর এই তেমন বই মিলতে পারে বইমেলায়। যেখানে দেখিবে ছাই উড়ায়ে দেখ তায়/ পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ফেব্রæয়ারি মাসে বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির কারণে এক বছর চট্টগ্রামে বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যেখানে মানুষের বাঁচামরার প্রশ্ন সেখানে ঝুঁকি নিয়ে কোনো কিছু করতে যাওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। তবে বাঙালির জীবনে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা বইমেলায় গেলে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বইমেলা শুধু বই বিক্রির মেলা নয়। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনমেলা। আসলে এটি একটি উৎসবও। নানা ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় অনেক প্রিয়জনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার ফুরসত হয়ে ওঠে না। হঠাৎ দেখা গেল কোনো এক স্টলে সেই প্রিয়মুখ বই নাড়াচাড়া করছে। শুরু হলো পরস্পরের কুশল বিনিময়, সে সাথে পছন্দের বইটি কেনা হলো। আর যদি বরাত ভালো থাকে দেখা হয়ে যায় বইয়ের লেখককে। বাড়তি পাওনা হিসেবে পাওয়া যায় লেখকের অটোগ্রাফ। এর চেয়ে আনন্দজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে।
বইমেলার এ মহামিলনের জন্য দীর্ঘ এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে লেখক, প্রকাশক, শিল্পী এবং সংশ্লিষ্টরা। আর যখন মেলা শুরু হয় অমনি প্রজাপতির মতো নেচে ওঠে বই অনুরাগী মানুষের মন। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের আনন্দটা আরও বেশি। বইমেলাতে গেলেই এটা ওটা কোনোটাই বাদ দিতে চায় না ছোটরা। মায়ের কাছে, বাবার কাছে বায়না ধরে এই বই চাই, ওই বই কিনে দিতে হবে। রূপকথার বই, দেও দানো ভূতপ্রেতের বই, মোটোপাতলু, ডরিমনের বই সব বই যেন তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া চাই। পড়ুক আর নাই পড়ুক বইয়ের প্রতি শিশুদের এ অপার আনন্দ পাল্টে দেয় মেলার পরিবেশে – মেলা যেন হয়ে ওঠে রূপকথার স্বপ্নপুরি।
বই পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন নানা যন্ত্র বিনোদনসহ সব কিছুর উৎস হয়ে ওঠেছে। শিক্ষা, তথ্য, দেশবিদেশের খবরাখবর সবকিছুই। ফলে হাতে নিয়ে বইপড়া, বইকেনার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে বইয়ের সাথে শিক্ষিত থেকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ পর্যন্ত সবার রয়েছে আত্মার নিবিড় সম্পর্ক। যারা বই থেকে নিজেদের মন মানসিকতা গঠন এবং আত্মার খোরাক খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেন। বই মেধা বিকাশ এবং মানসিক পরিতৃপ্তির আশ্রয়স্থল। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও বইয়ের বুকে গাথা পৃষ্ঠার অক্ষর বা ছবিতে হাত বুলিয়ে বইয়ের ভেতর বিস্তৃত সত্য ও সুন্দরের পরশ নেওয়ার চেষ্টা করে।
প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংশ্লিষ্টদের অর্থ, শ্রম, ভালোবাসা। তাই লেখক কিংবা প্রকাশকের কাছে সৌজন্য কপি নয় বরং সৌজন্য মূল্যে বই কিনে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো সবার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ চরিত্র গঠনে, সত্যভাষী নির্ভীক চিত্তের আগ্রামী প্রজন্ম বিনির্মাণে, নৈতিকতা বোধ সৃজনে, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ জাগাতে, সামাজিকরণে, ধর্মের প্রতি অনুরাগী করে গড়ে তুলতে যাঁরা নিজেদের শ্রম, মেধা, মননকে নিরন্তর নিয়োজিত রেখেছেন সামান্য একটা বই কিনে আমরা যদি তাদের উৎসাহিত না করি তাহলে একজন মানুষ হিসেবে, একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই বিবেকের কাছে অপরাধী হব। তাই প্রতি বছর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করে চট্টগ্রামের মানুষ, কখন শুরু হচ্ছে বইমেলা —প্রাণের মেলা।
২০১৯ সালের আগে চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় বইমেলা হতো। চট্টগ্রামের ডিসি পাহাড়, লালদিঘি ময়দান এবং মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় বইমেলার আয়োজন করা হতো। এসব বইমেলায় না ছিল জৌলুস, না ছিল বইপ্রেমিদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। সাবেক মেয়র মনজুর আলমের আমলে মুসলিম হলের বইমেলায় সম্পৃক্ত হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তখন থেকে একটি অভিন্ন বইমেলার দাবি উঠতে থাকে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদসহ চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবিদের পক্ষ থেকে। এই দাবি আরও জোরালো হয় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। আ.জ.ম নাছির উদ্দীন-এর পরম আন্তরিকতায় অবশেষে পূর্ণ হয় একটি অভিন্ন বইমেলার স্বপ্ন। ২০১৯ সালে আয়োজিত হয় প্রথম অভিন্ন বইমেলা, তার জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় চট্টগ্রামের নাভি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়াম চত্বরকে। প্রথম আয়োজনে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে এই বইমেলা। চট্টগ্রামের একটি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯সালে বইমেলায় আনুমানিক সাড়ে তের কোটি টাকার বই বিক্রয় হয়েছিল। আর ২০২০ সালে বই বিক্রয় হয়েছিল ১৮ কোটি টাকার বই( দৈনিক আজাদী / তাং ২৭/০২/২১)। উপর্যুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই বইমেলা ও বইকেনার প্রতি সচেতন মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না ঐ দুটো বইমেলায়।
২০১৯, ২০২০ এবং ২০২২ সালের ধারাবাহিকতায় এবারও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বইমেলা আয়োজন করার ঘোষণা দিয়েছে এবং আগামী ৮ ফেব্রæয়ারি থেকে শুরু হবে প্রাণের সেই বইমেলা। আমরা আশা করব প্রতিবছরের ন্যায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দর্শক ও ক্রেতায় জমজমাট একটি সুন্দর বইমেলা বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষকে উপহার দেবে। তবে তার জন্যে প্রয়োজন চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী, সাংবাদিক ও মিডিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সর্বাত্মক সহযোগিতা। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও আন্তরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই আমরা পেতে পারি একটি অর্থবহ বইমেলা। কারণ বৈশ্বিক মহামারিজনিত প্রকাশনা শিল্পের বিরাট আর্থিক ক্ষতি, সে সাথে এবার যুক্ত হয়েছে মুদ্রণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি। ফলে প্রকাশনা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। এবারের বইমেলা সার্থকভাবে অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করছে প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যত। তাই বইমেলাকে সার্থক করে তুলতে আয়োজক প্রতিষ্ঠান, সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ ও বইপ্রেমী নাগরিক যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখুক এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক